মো. মারুফ মজুমদার, চবি

  ০৭ জানুয়ারি, ২০২৪

পরিবারের সঙ্গে ক্যাম্পাসে একদিন

স্মৃতির পাতায় স্বর্ণালি অক্ষরে লিখে থাকুক একটি দিন; যখন বাবা-মা, ছোট্ট দুবোন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁতুড়ঘরখ্যাত নিজ ক্যাম্পাস তথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বেড়াতে আসেন। মরুভূমির বুকে তৃষ্ণার্থ পথিক যখন হঠাৎ করে পানির সন্ধান পেলে তার মনের গহিনে যে অদ্ভুত শান্তির লহরী খেলে, ঠিক তেমনি হৃদয় সরোবরে মিহি অনুভূতি আন্দোলিত হয়েছিল আমার বাবা-মার ক্যাম্পাসে আগমনে। প্রত্যেকের কাছে তার বাবা-মা আল্লাহ প্রদত্ত একটি নির্ভেজাল আশীর্বাদ। যদি সেই আশীর্বাদপুষ্ট দুজন মানুষ, তাদের ছেলের স্বপ্নের ক্যাম্পাসে আসেন তাহলে তার আনন্দ ঠিক কতখানি বিস্তার করবে, তা শব্দে বর্ণনা করা কঠিন বৈকি।

দিনটি ছিল রবিবার (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩)। বিজয় দিবসকেন্দ্রিক ছুটিতে মূলত ক্যাম্পাসে আসেন তারা। বাবার চাকরি, মায়ের পরিবার সামলানোর মতো সমান ব্যস্ততাকে এক দিনের জন্য ছুটি দিয়ে একমাত্র ছেলের ক্যাম্পাস দেখতে চলে এলেন। কুমিল্লা থেকে ট্রেন ভ্রমণ, অতঃপর খালার বাসায় রাত্রি যাপন শেষে পরের দিন কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে সোনালি সূর্যের তপ্ত কিরণ ঘায়ে মেখে রওনা দিলেন চবি ক্যাম্পাস দেখার উদ্দেশ্য। সিএনজি করে ১ নম্বর গেট দিয়ে চবির ২৪তম ব্যাচ কর্তৃক সুবিশাল গেটের দ্বারপ্রান্তে নামলেন, যাকে হরহামেশাই জিরো পয়েন্ট নামে ডাকি। (এই জিরো পয়েন্ট জায়গাটির আলাদা বিশেষত্ব আছে। যেখান থেকে চাইলে ক্যাম্পাসের যেকোনো দিকে যেতে পারেন। আছে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া শহীদের স্মরণে ভাস্কর্য। সন্ধ্যায় সোডিয়াম নিয়নের আলোয় শিক্ষার্থীদের সমাগমে মুখরিত থাকে এই প্রাঙ্গণ)। একু শ একরের বিস্তৃত ক্যাম্পাসে হেঁটে দেখা অসম্ভব বিধায় একটি রিকশা ভাড়া করে নিলাম। এরপর জিরো পয়েন্ট থেকে হাতের বাম দিকে শাহজালাল, আমানত, সোহরাওয়ার্দী হল রোড দিয়ে আলাওল, এফ রহমান ঘুরে ২ নম্বর গেট যাই। ঝটিকা নাশতা করে আইন ফ্যাকাল্টিতে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে। সঙ্গে মেডিকেল সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর ভবন, সক্রেটিস চত্বরের পাশের রোড দিয়ে সেন্ট্রাল ফিল্ড দেখতে নামি।

আয়তনে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ এত বিশাল যে, যে কেউ প্রথম দেখায় হতচকিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পাশেই জিমনেশিয়াম ভবন। একটু সামনে হাঁটলে দেখতে পাওয়া যায় দেশসেবায় ব্রত প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি রিজার্ভ শাখা তথা বিএনসিসি অফিস। দীর্ঘ তিন বছর নেভাল উইংয়ে থাকায় জমাটবদ্ধ স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগ হলো বাবা-মাকে নিয়ে। অতঃপর রিকশায় করে চলে যাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভবন (সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ)। যাওয়ার পথিমধ্যে রাস্তা দুধারে তরুলতা ঘেরা পাহাড়ের সুবিস্তীর্ণ সৌন্দর্য ছিল মুগ্ধ করার মতো।

ভবনে পৌঁছে, দোতলায় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে যাই। এই বিভাগটি সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ যে তিনটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে এগুলোর পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট অন্যতম। বাবা-মা বিভাগের ক্লাসরুম, সেমিনার লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, করিডরের নান্দনিক সৌন্দর্যে অভিভূত। ফটোসেশন হলো। তৃতীয়তলার টাইটানিক চত্বর গেলাম। সূর্যের সোনালি কিরণ ততক্ষণে মাথার ওপর তির্যকভাবে তার রশ্মি বিলাতে ব্যস্ত। মসজিদ থেকে আজানের মনকাড়া ধ্বনি, সূর্যের তপ্ত আলোয় বুঝতে বাকি রইল না দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। ক্যানটিনে দুপুরের খাবার শেষ করে, খানিক সময় জিরিয়ে আবার বের হলাম। গেলাম বুদ্ধিজীবী চত্বর, সামনেই সুপ্রাচীন শহীদ মিনার, পাশেই জয়বাংলা চত্বর। এই ত্রয়ী ভাস্কর্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে একটি বেনি সুতোয় বাঁধিয়ে রেখেছে, তা দেখা মাত্র মনে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের খন্ডচিত্র।

জয়বাংলা চত্বর ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলে দেখা যায় শৈল্পিক স্থাপত্যশিল্পের সুনিপুণ কারুকাজ খচিত আইটি বিল্ডিং, পাশেই রয়েছে দোতলার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, তারই পাশে বাংলাদেশের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। সামান্য সামনে হাঁটতেই দেখা যায় উন্মুক্ত মঞ্চ, রাস্তার বিপরীত ধারে জারুলতলা, অদূরে বিশাল শ্বেত আকৃতি পুরোনো কলাভবন, পাশেই প্রশাসনিক ভবন।

কলা ঝুপড়ির পেছনে ঝরনা দেখা বাদ রইল না। নির্জীব চাকসু ভবন দেখার পর চলে গেলাম বিজ্ঞান অনুষদ দেখতে, রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলে দেখতে পাওয়া যায় পাম বাগান- সেখানেও ঘুরে এলাম। গেলাম নব ফিশারিজ অনুষদ ভবন। ভবনটির নতুন আঙ্গিক যে কাউকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে বাধ্য। অতঃপর চবির ফুসফুসখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে, ফরেস্ট্রির অনুষদ ঘুরে জিরো পয়েন্ট এসে পৌঁছালাম। ততক্ষণে বিকেল শেষে গোধূলির আকাশে রক্তিম আভাস। বুঝলাম এখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।

সবশেষে, বাবা-মা ও দুই বোনকে সঙ্গে নিয়ে শাটল ট্রেন ভ্রমণ। বাংলাদেশের একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা- ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা তো অন্য রকমম হবেই। পরিবারের সঙ্গে একটি দিন আমার দ্বিতীয় পরিবারে (নিজ ক্যাম্পাস) বিচরণ করার মতো আনন্দের দ্বিতীয়টি নেই। অনেক দিনের স্বপ্ন, অবশেষে পূরণ হলো।

এভাবেই স্মৃতি রোমন্থনতুল্য একটি দিনের সুন্দর সমাপ্তি। চবির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এত বিশাল যে এক দিনে এর সিকিভাগ দেখাও অসম্ভব। সাধ্যের সবটুকুন দিয়ে দেখার প্রয়াস। পুরো ক্যাম্পাস দেখতে চাইলে হাতে সময় নিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়। নয়তো আক্ষেপ নিয়ে আপন নীড়ে ফিরতে হবে। বলতে হয়, অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের কাছে এ যেন অনেক। তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণ করাও নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়।

আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই এসেছে ক্যাম্পাসে কিন্তু বাবা-মা আসেনি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই বিজয়ের মাসে বাবা-মাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা যেন আমার কাছে অনেক খুশির ব্যাপার। পৃথিবীর সব বাবা-মা ভালো থাকুক, ভালো রাখুক তাদের সন্তানদের দ্বারা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close