গাজী শাহনেওয়াজ
মেরিন একাডেমির বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে অধিদফতর
দেশ-বিদেশে মেরিন ক্যাডেটদের চাকরির বাজার ভালো
অধিকাংশ বেসরকারি মেরিন একাডেমির নানা সমস্যা, অনিয়ম, প্রতারণা ও চাকরির মন্দা বাজারের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চায় নৌপরিবহন অধিদফতর। বিদেশে মেরিন ক্যাডেটদের চাকরির বাজারে যে বাধা ছিল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তা দূর করতে উদ্যোগী হচ্ছে অধিদফতরটি। এর কর্মকর্তারা মনে করেন, শিগগিরই সম্প্রসারণ হচ্ছে মেরিন ক্যাডেটদের চাকরির বাজার।
জানা গেছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি মেরিন একাডেমির শিক্ষাকার্যক্রম। সেগুলোর শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ নেই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। শ্রেণিকক্ষের সংকটের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর সংখ্যানুপাতে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। গবেষণাগারসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে ব্যাপক। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নৌপরিবহন অধিদফতর। জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালন কমোডর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘মেরিন একাডেমিগুলোর শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আমাদের একটা ক্রাইটেরিয়া রয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী যে প্রতিষ্ঠানগুলো যোগ্য (কোয়ালিফাইড) তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাকিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ১৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টি অপারেশনে থাকলেও তাদের মধ্যে কয়েকটির ক্যাডেট তৈরির উপযোগী পরিবেশ নেই। তাদের মধ্যে যেগুলোর ক্রু রয়েছে তারা প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে (সারভাইভ) রাখছে।’
তিনি বলেন, ক্যাডেটদের চাকরির ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি সব বাজারই মন্দাভাব রয়েছে। কিন্তু যখন সøাপাই অব ডিমান্ড বাড়বে তখন মন্দাভাব কেটে যাবে। কমোডর আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘চাকরির বাজারে মন্দাভাব, প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও চাকরি না হওয়াসহ নানা ধরনের অসুবিধা ছিল। এসব বাধা কাটাতে আমি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ভিসা ইস্যু। এর কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার্থী সব দেশে চাকরি পেত না। আমি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমঝোতা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,
ইতোমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফিডব্যাকও পেয়েছি। এমনকি ভারতে কিছু জটিলতা ছিল তাদের সঙ্গে বসে সেগুলোর অনেকাংশে সমাধান করা হয়েছে। পাশাপাশি ভারত সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা (রেসটিকশন) ছিল সেগুলো তুলে নিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক শিপিং পলিসি-সংক্রান্ত একটি সেমিনার গত ২৭ আগস্ট হোটেল র্যাডিসনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখাকে আইএমওর মহাসচিব উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া দেশীয় ওনারদের পাশাপাশি বিদেশি কিছু নামকরা শিপিং কোম্পানির প্রতিনিধিরা ওই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠিত সেমিনারে যারা পেপার উপস্থাপন করেছেন সেখানে বিদেশিদের যেসব শর্ত ছিল সেগুলোর জবাবও সেখানে ছিল। আমি আশা করছি, এর মাধ্যমে আমাদের শিপিং সেক্টরের শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারে যে মন্দাভাব চলছিল তা সম্প্রসারিত হবে।
সূত্র মতে, বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা ১৮টির মধ্যে কয়েকটি মেরিন একাডেমির বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। বিদেশি জাহাজে মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি, রোমাঞ্চকর সামুদ্রিক ও জীবন-এমনই বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মেরিন ক্যাডেট তৈরির নামে প্রতারণা করছে তারা। মাত্র তিন বছরের কোর্সের জন্য ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা নেওয়া হলেও বেশির ভাগ ইনস্টিটিউটে নেই শিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ। কোর্স শেষে মেলে না প্রত্যাশিত চাকরি, এমনকি উল্টো জাল কাগজপত্র বানিয়ে বিদেশি জাহাজে প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থী পাঠানোর ঘটনা ঘটছে। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশ গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। শুধু তাই নয়, লাখ লাখ টাকা নেওয়ার পরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে জাল সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগও মিলেছে। এ রকম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অন্তত পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয় নৌপরিবহন অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিটাইম একাডেমি, ওশান মেরিটাইম একাডেমি (ওএমএ), ন্যাশনাল মেরিন একাডেমি অব বাংলাদেশ, প্যাসিফিক মেরিটাইম একাডেমি এবং ইউনাইটেড মেরিটাইম একাডেমি।
গত ৯ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের সিলেবাস অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষার পরিবেশ উপযোগী ক্লাসরুমের ব্যবস্থা, শিক্ষকসহ বেশ কিছু শর্তপূরণের নির্দেশনা ছিল। অনেকগুলো তাদের শর্তপূরণ সাপেক্ষে হালনাগাদ তথ্যসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
দেশের একমাত্র সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামে মেরিন একাডেমির যাত্রা শুরু হয় ১৯৬২ সালে। তখন থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৫০ জন ক্যাডেট ওই একাডেমিতে ভর্তি হয়। সে হিসেবে ৪৫ বছরে ক্যাডেট ভর্তির হারই দাঁড়ায় সাড়ে ২২০০ জনে। প্রতি বছর ক্যাডেট ভর্তির সংখ্যা ৫০ জন থেকে ৫০০ জনে উন্নীত করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয় ২০০৭ সালে। এর জন্য অবকাঠামোগত সুবিধাও বৃদ্ধি করা হয়। তৎকালীন সময়ে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র-বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে বর্ধিত সংখ্যায় ক্যাডেট ভর্তির কাজ ওই সময় থেকেই শুরু করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে ওই একাডেমিতে ৫০০ জন করে ক্যাডেট ভর্তির কাজ শুরু হয়। ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়কালে ৭৬৭ জন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়। জাহাজে নিয়োগ পাওয়ার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে গড়ে ছয় মাস। এরপর আন্তর্জাতিক সমুদ্র-বাণিজ্যে মন্দা নেমে আসে। তাতে প্রতি বছর সংকুচিত হয়েছে ক্যাডেটদের চাকরির সুযোগ। ২০১৩ সালে ১৬ জন নারীসহ ৩০৪ জন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয় মেরিন একাডেমি থেকে ৪৮তম ব্যাচে। এই ব্যাচের কিছু ক্যাডেট এখনো প্রথমবারের মতো জাহাজে ওঠার সুযোগ পায়নি। ২০১৪ সালে মেরিন একাডেমির প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হওয়া ক্যাডেট সংখ্যা ২৩৫। তাদের মধ্যে নারী ক্যাডেট ১৯। এক বছরে জাহাজে নিয়োগ পেয়েছে মাত্র ৫০ জনের মতো। ২০১৫ সালে পাসিং আউট বর্ষে প্রশিক্ষিত ক্যাডেট সংখ্যা ৩১২ জন। তাদের মধ্যে ১৩ জন নারী।
তবে নৌপরিবহন অধিদপতরের সাম্প্রতিক উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের চাকরির বাজারে মন্দাভাব কাটতে যাচ্ছে বলে আশায় বুক বাঁধছেন পাস করা ক্যাডেটরা। আর সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব সমস্যার কারণে এ দেশীয় মেরিন ক্যাডেটরা পিছিয়ে ছিল অদূর ভবিষ্যতে তাদের কর্মসংস্থান হবে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার খরচ কম হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশি ব্যয় হয়। কোর্সসমূহ : ডিপ্লোমা ইন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং চার বছর, ডিপ্লোমা ইন শিপবিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং চার বছর, মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন আর্টিফিসার দুই বছর, শিপ ফেব্রিকেশন দুই বছর, শিপবিল্ডিং ওয়েল্ডিং দুই বছর, শিপবিল্ডিং ড্রাফসম্যানশিপ দুই বছর, ব্যাচেলর অব মেরিন সায়েন্স তিন বছর, বিএসসি (পাস) ইন নটিক্যাল তিন বছর, বিএসসি (পাস) ইন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং তিন বছর ও বিএসসি (পাস) ইন মেরিন ফিশারিজ তিন বছরের কোর্স। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ সমুদ্রগামী জাহাজের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। জাহাজচালনা, নৌ-প্রকৌশল, ইলেকট্রনিক ও যোগাযোগব্যবস্থা অথবা হোটেল সার্ভিস ইত্যাদি। তিন বছরের কোর্স শেষে এসব বিভাগের যে কোনো একটিতে যোগ দেওয়া যায়। তবে যারা প্রিসি নটিক্যাল সায়েন্সে পড়াশোনা করেন, তারা জাহাজচালনা বিভাগে যোগ দেন।
"