ছায়েদ আহমেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী)

  ৩০ মার্চ, ২০২৪

নোয়াখালীর হাতিয়া

জেলেরা বৈষম্যের শিকার জীবন চলে অনটনে

জেলে সম্প্রদায়ের জীবনমান পরিবর্তনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা-প্রশিক্ষণ কিংবা সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তাদের অভাব-অনটনের জীবনে পরিবর্তন আসে না। বৈরী আবহাওয়া, জলদস্যুর আক্রমণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় জেলে কুলের দারিদ্র লেগেই থাকে। সমুদ্রগামী এসব জেলের জীবন একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে বছরের একটা বড় সময় তাদের বেকার বসে থাকতে হয়। এ সময় সুদের কারবারি কিংবা মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে কোনোমতে তাদের জীবন চালাতে হয়।

এজন্য মৎস্য অধিদপ্তর ও বিদেশি সংস্থা তাদের খাদ্য সহায়তাসহ বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু এই সহায়তা কিংবা বিকল্প কর্মসংস্থানের উপকরণ প্রকৃত জেলেরা পান না। বংশ পরম্পরায় যারা জেলে, সেই প্রকৃত জেলেরাই সরকারি তালিকায় নিবন্ধিত হতে পারেন না। যে কয়জন নিবন্ধিত হন তাদেরও আবার অধিকাংশ সহায়তা পান না। অথচ জীবনে কখনো মাছ শিকার করেননি, নদীপাড়েও যাননি- প্রধান পেশা ব্যবসা, মুদি দোকানি, পল্লী চিকিৎসক বা অন্য কিছু। কিন্তু তারা নিবন্ধিত জেলে। আছে জেলে কার্ডও। প্রতি বছর জেলে হিসেবে পান খাদ্য সহায়তাও। চাল বিতরণের দিন তারা লাইনেও দাঁড়াতে হয় না। অন্য লোকের মাধ্যমে চাল চলে যায় বাড়িতে। এমনই এক দুর্বিষহ ও বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকা হাতিয়ার বিভিন্ন জেলেপাড়া থেকে।

দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বুড়িরচর, চরচেঙ্গা ও জাহাজমারা মৎস্যঘাট এবং জেলে পল্লী ঘুরে স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান এসব তথ্য। চরচেঙ্গা মৎস্যঘাট এলাকার ফিশিং বোট মালিক গিয়াসউদ্দিন জানান, গত বৃহস্পতিবার জেলেদের জন্য যে চাল দেওয়া হয়, তা প্রকৃত জেলেরা পাননি। কার চালগুলো কে রিকশা ভরে নিয়ে যায়, তাও বোঝা যায়নি। তা ছাড়া অধিকাংশ সব ভুয়া জেলে পরিচয়ে নিবন্ধিত হয়েছে বলে জানান এই ফিশিং বোট মালিক।

বুড়িরচর ইউনিয়নের মধ্য রেহানিয়া গ্রামের জেলে আবদুল গণি (নিবন্ধিত ফরম নম্বর ৫০৬৪৭৬৯) জানান, কারা আমার স্বাক্ষর দিয়ে চাল নিয়ে যায়, তা আমি জানি না। আমি গত ২-৩ বছর খাদ্য সহায়তা পাইনি। দক্ষিণ রেহানিয়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিন (জেলে নিবন্ধন ফরম নম্বর ৪৯৮৭৫০৬)। এই মৃত ব্যক্তির নামেও অন্যরা চাল উত্তোলন করে নিয়ে যায়।

একই ইউনিয়নের বড় দেইল এলাকার পল্লী চিকিৎসক মো. আরিপ উদ্দিন ভুয়া জেলে পরিচয়ে নিবন্ধিত হন। তার নিবন্ধন ফরম নম্বর ৫০৬৪৮২২ এবং তিনি চালও পান। বেলাল মাঝি নামের এক সমুদ্রগামী জেলে জানান, নিবন্ধন এবং জেলে কার্ড থাকার পরও তিনি কোনো সহায়তা পাননি।

এখানকার বেড়িবাঁধের তীরে বাস করা পিয়রা, মমতা, জোসনা, জাহেদাসহ অসংখ্য নারী অভিযোগ করে বলেন, তাদের স্বামীরা জন্মলগ্ন থেকে জেলে। অথচ তাদের নিবন্ধন হচ্ছে না। তারা আরো জানান, গত ৫ মাস আগে ইউএনডিপির প্রতিনিধিরা এসেও তাদের খোঁজখবর নিয়ে গেছেন। তবু তারা আশানুরূপ কিছু দেখছেন না বলে আক্ষেপ করেন জেলেপাড়ার এসব নারী। স্থানীয় জেলে আবদুল কাদেরও একই অভিযোগ করেন।

জাহাজ মারা কাটাখালি মৎস্যঘাট এলাকার সমুদ্রগামী জেলে অলি উদ্দিন জানান, তার জেলে কার্ড আছে তবু খাদ্য সহায়তা পান না গত ৩ বছর। তিনি জানান, গতকালও নদীতে মাছ শিকারে গিয়েছিলাম কিন্তু মাছ পাইনি, কষ্টে দিন কাটে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের আত্মীয়রা পান সব সুবিধা। তা ছাড়া প্রকৃত জেলেরা ৫ জনও নেই নিবন্ধনের আওতায়, সব মুদি দোকানি এবং অন্যরা পান এসব সুবিধা। এ বিষয়ে বুড়িরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম জানান, ভুয়া জেলে নামধারীদের শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুবিধাবঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার এসব জেলের বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাজু চৌধুরী জানান, ভুয়া জেলেদের নাম নিবন্ধিত হওয়ার বিষয়টি আগে ঘটেছে। তার সময়ে এমন ঘটনা ঘটেনি বলে উল্লেখ করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।

এছাড়া বেড়িবাঁধ এবং জেলেপাড়ার আশপাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার পরও জেলেদের সন্তানরা শিক্ষালয়মুখী না হওয়ার চিত্রটিও উঠে এসেছে একই সঙ্গে। সমুদ্রগামী জেলে কিংবা মৎস্যজীবীদের সামগ্রিক জীবনমানের টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, এসব বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ পরিকল্পনার দরকার। এবং যেসব জেলে এখন বিভিন্ন সহায়তা পাচ্ছেন তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করে কি না, এই মর্মে প্রত্যয়নও আবশ্যক করা দরকার সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close