মিজান রহমান

  ১৭ আগস্ট, ২০২২

মধ্যবিত্তের টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ

রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ইনজিনিয়ার পদে চাকরি করেন মাইনুল হাসান। বেতন পান সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মিরপুরের কাজীপাড়ায়। বাসাভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এবং অফিসে যাতায়াত। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি সংকটসহ নানামুখী সংকটে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মাইনুল।

কেমন আছেন জানতে চাইলে মাইনুল হাসান বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এর ফলে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এ ছাড়া খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দামও বেড়ছে। এক হালি ডিমের দামই ৫৫ টাকা। কী খাব? কোথায় যাব? কার কাছে বলব? এমন অবস্থায় অনেকের জন্যই টিকে থাকাটা বড় চ্যালেঞ্জ।

মাইনুল হাসান বলেন, বেতনের একটি বড় অংশ বাড়িভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারি না। নিজের পছন্দের খাবার বা পোশাক কেনা সম্ভব হয় না। মাস শেষ হওয়ার আগেই ধারদেনা করে চলতে হয়।

শুধু মাইনুল হাসান নন, এ রকম অধিকাংশ মধ্যবিত্তের মানুষের এখন টিকে থাকা দায়। গত শুক্রবার (৫ আগস্ট) দিনগত মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রতি লিটার ডিজেলে বেড়েছে ৩৪ টাকা, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে বেড়েছে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে হচ্ছে ১১৪ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি লিটার কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ ও পেট্রল ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গণপরিবহনে ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

কোভিড মহামারির ধাক্কায় গত দুই বছরে অনেক মধ্যবিত্ত চাকরি হারিয়েছেন। প্রায় সবারই দুই বছর ধরে এক টাকা বেতন বাড়েনি। উল্টো মহামারিতে ব্যবসা নেই অজুহাতে কারো কারো বেতনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে মালিক পক্ষ। মধ্যবিত্ত অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা অর্ধেকে নেমে গেছে। পুঁজি ভেঙে চলার কারণে এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়াতে পারছেন না। আশায় ছিলেন মহামারি গেলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে পড়ে তাদের এখন পিষে মরার দশা। ?অনেক মধ্যবিত্তই এখন নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাতারে চলে গেছেন। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবি পণ্যের ট্রাক থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানেও দাম একেবারে কম না।

বনশ্রীতে একটি সুপারশপে কাজ করেন সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা আরিফ। আলাপকালে তিনি বলেন, ছাত্র অবস্থায় তিনটি টিউশনি করতাম। তখন মাসে আট-নয় হাজার টাকা আয় হতো। এই টাকার একাংশ দিয়ে মেসে থাকতাম। বাকি টাকা টাঙ্গাইলে বাড়িতে পাঠাতাম মা-বাবার হাত খরচের জন্য। এখন ১৪ হাজার টাকা বেতন পাই। কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্য বাড়ায় মেস ভাড়া, খাবার খরচ, পকেট খরচ দিয়ে মাস শেষে তেমন কিছুই থাকে না। বাড়িতেও ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারি না।

শুধু চাল-তেল-ডিমই নয় নিত্যপণ্য সবজিসহ সবকিছুর দাম শুধু বাড়ে, কমে না। কাঁচাবাজার থেকে ৭০ টাকা দিয়ে একটি লাউ, ৬০ টাকা কেজিতে পটোল ও করলা, ৩০ টাকা কেজিতে আলু কিনে বাসায় ফিরছিলেন সেকান্দার আলী। তিনি জানান, তিন দিন আগেও এই বাজার থেকে শাকসবজি কিনেছেন আরো কম দামে। এখন প্রতিটি সবজিতেই ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন দোকানিরা। চাল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ সবই এক এক করে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মসুরের ডাল ১৪০, পেঁয়াজ ৪৫ ছুঁইছুঁই, চিনি ৮৫ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৮৫ টাকা। এই যে সবকিছুতেই বাড়তি দাম, তা মেটাতে মাসের বাজার খরচে যোগ করতে হয়েছে বাড়তি তিন/সাড়ে তিন হাজার টাকা। বেতনের সঙ্গে তো এ টাকা যোগ হয়নি। তবে কোথা থেকে আসবে এই বাড়তি অর্থ।

তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ায় শুধু কাঁচাবাজার নয়, জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে না খেয়ে দিন পার করতে হবে। বাড্ডা লিংক রোডে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিলেন সোহেল রানা। আলাপকালে তিনি জানান, পাইকারি বাজার থেকে তারা সবজি কিনে আনেন। পাইকাররা সব সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য তারাও সবজি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, বেশি দামে সবজি বিক্রি করলেও আমাকেই আবার চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ বা মাংস বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দেশের সব মানুষ এমন চক্রাকারে আটকে গেছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মানুষের কষ্ট আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রথমেই ধাক্কা খেয়েছে পরিবহন সেক্টরে। আর পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সবই সম্পৃক্ত। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। ফলে আরো বাড়বে পণ্যের দাম। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এই দাম আরো অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশাহারা হয়ে পড়বে। ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ আর ভালো থাকতে পারে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close