বরগুনা প্রতিনিধি

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

৩৫ দিন হাজতবাস ভুয়া পরোয়ানায়!

বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের বাসিন্দা বাদল মিয়া। কৃষিকাজ করেই পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলেন তিনি। ৫৭ বছর বয়সে জীবনে কখনো তিনি রাজধানী ঢাকা শহর যাননি। কিন্তু সেই ঢাকারই এক শিশুকে ধর্ষণের মামলায় শিশু আদালতের ওয়ারেন্টের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করে বরগুনা থানা পুলিশ। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে ওয়ারেন্টের বলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ওয়ারেন্টটাই ছিল ভুয়া। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের কারণে ৩৫ দিন হাজতে থাকতে হয়েছে বাদল মিয়াকে। গতকাল মঙ্গলবার রাতে বরগুনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাদল মিয়া। এ সময় তার ছেলে, স্বজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী উপস্থিত ছিলেন।

বাদল মিয়ার অভিযোগ, স্থানীয় দালাল সাইফুল এবং ইলিয়াস ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসিয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রথম আমাকে পুলিশ যেদিন গ্রেপ্তার করে তারপর ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনে আমাকে সাইফুলদের বাড়িতে চার দিন আটকে রাখে। আমার মনে হয় আমার ক্ষতি করার জন্য পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে সাইফুল ও ইলিয়াস এই ভুয়া ওয়ারেন্ট বানিয়ে আমাকে আটক করায়। আমি জীবনে কখনো ঢাকা যাইনি অথচ সেই ঢাকারই একটি শিশু ধর্ষণ মামলায় আমাকে ৩৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে। যারা আমার সঙ্গে প্রতারণা করে আমাকে জেল খাটিয়েছে আমি সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সেই সঙ্গে সরকারের কাছে দাবি জানাই, যাতে আর কোনো নিরাপরাধী এভাবে ভুয়া ওয়ারেন্টে জেল না খাটে। সেজন্য পুলিশ প্রশাসনকে আরো তৎপর হয়ে ওয়ারেন্টটির সত্যতা নিশ্চিত করে তবেই কাজ করতে হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর বরগুনার সদর থানা পুলিশের এএসআই সাইফুল ইসলাম ঢাকার শিশু আদালতের ৯(১) ধারায় করা শিশু ধর্ষণ মামলায় একটি ওয়ারেন্টের বলে বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করেন। থানায় স্থানীয় পুলিশের সোর্স ইলিয়াস ও সাইফুলের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে নেন বাদলের স্বজনরা। এর অল্প কিছুদিন পর ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ আবার একই মামলার ওয়ারেন্টে বরগুনার সদর থানার আরেক এএসআই নাইমুর আবারও গ্রেপ্তার করেন বাদল মিয়াকে। এ পর্যায়ে কোনো মীমাংসা না হলে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এরপর বাদল মিয়ার ছেলে বাবাকে মুক্ত করার জন্য ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন ঢাকা জজ কোর্টে শিশু আদালত বলতে কোনো আদালত নেই। সেখানে ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, যেগুলো শিশু আদালত হিসেবে কাজ করে। এর কোনো আদালতেই বাদল মিয়ার বিরুদ্ধে যে ওয়ারেন্টের কাগজ দেখানো হয়েছে সেই মামলার উল্লেখ নেই। ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু আদালতে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মামলাটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতের বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে আদালতের বিচারক বিষয়টি আমলে নিয়ে বাদল মিয়াকে মুক্তি দেন।

মামলার ওয়ারেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওয়ারেন্টে মামলা নম্বর হিসেবে লেখা হয়েছে জিআর ৪২৫/১৭ ও শিশু-৮৯০/১৮। এ ছাড়া অপরাধ হিসেবে লেখা হয়েছে শুধু ৯(১) ধারা। পাশাপাশি মামলা নম্বরে ২০১৭ সাল উল্লেখ থাকলেও বিচারকের সইয়ে স্থলে তারিখ দেওয়া হয়েছে ০৪/০৪/১৪। মামলা ২০১৭ সালের হলেও ওয়ারেন্টে ২০১৪ সালের বিচারকের সই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ছাড়া ওয়ারেন্টে আদালতের সিল থাকার কথা থাকলেও এই ওয়ারেন্টে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিল রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দাখিল করা ওয়ারেন্টটি ভুয়া বলে ধারণা করা হয়।

ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মনোয়ার হোসেন জুয়েল বলেন, ‘ওয়ারেন্টে যে মামলার নম্বর উল্লেখ রয়েছে আমরা সেই নম্বর অনুযায়ী ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু আদালতে তল্লাশি চালিয়ে দেখেছি এ রকম কোনো মামলার অস্তিত্ব এখানে নেই। মামলায় যে বিচারকের সই ব্যবহার করা হয়েছে, সেই সইটিও জাল। এতে প্রতীয়মান হয়, ওয়ারেন্টটি সম্পূর্ণ ভুয়া।’

বাদল মিয়ার ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘আমার বাবাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশ ও স্থানীয় দালাল যৌথভাবে আমার বাবাকে হেয়প্রতিপন্ন ও আমাদের ছোট করার জন্যই এ কাজ করেছিল। আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করার পর আমি নিজে ঢাকার সব শিশু আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে এই ধরনের কোনো মামলার অস্তিত্ব পাইনি। প্রত্যেকটি আদালতের সার্চিং স্লিপ আমরা উত্তোলন করে এনেছি। আমার বাবাকে যারা ফাঁসিয়ে ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’

একই সঙ্গে একটি ভুয়া ওয়ারেন্ট দেখিয়ে একই ব্যক্তিকে পুলিশের দুজন এএসআই কীভাবে ধরে নিয়ে যায় বা ছেড়ে দিতে পারে সে বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। আদালতের এবং পুলিশ প্রশাসনের উচিত বিষয়টি তদন্ত করে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং তাদের সোর্সদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

এ বিষয়ে এএসআই সাইফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া পুলিশের সোর্স সাইফুল ও ইলিয়াসের মোবাইল ফোনে কল করে তাদের পাওয়া যায়নি। তবে এএসআই নাঈমুর রহমান বলেন, ‘আদালতের আদেশ অনুযায়ী বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে আমি আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করি।’

বরগুনা সদর থানার ওসি কে এম তারিকুল ইসলাম বলেন, অন্যসব গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির মতোই বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। সব ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close