আশরাফুল আলম সাজু, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম)

  ০১ এপ্রিল, ২০২০

গৃহস্থ বাড়ির সেই ঢেঁকি!

পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবী সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে। চারদিক পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত। এমনই পরিবেশে কৃষকের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ছাঁটেন গৃহিণীরা। পাখির কিচির-মিচির ডাকের সঙ্গে ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ ভেসে বেড়ায় কৃষকের আঙিনায়। কালের বিবর্তনে দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এক কালের কৃষক-কিষানীর ধান ভাঙার প্রধান যন্ত্র ঢেঁকি। অতীতে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ধান থেকে চাল তৈরির জন্য কিংবা চালের গুঁড়া তৈরির জন্য ঢেঁকিই একমাত্র ছিল ভরসা। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। একসময় ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি লুকিয়ে ছিল আমাদের গ্রামবাংলার প্রাচীন জনপদে। ভোরের আজানের পাশাপাশি স্তব্ধতা ভেঙে ঢেঁকির শব্দ ছড়িয়ে পড়ত গ্রামের চারিদিকে। এখন আর সেই শব্দ নেই। চোখে পড়ে না বিয়ে সাদির উৎসবের ঢেঁকি ছাঁটা চালের ফিরনি-পায়েস। অথচ এক দিন ঢেঁকি ছাড়া গ্রাম কল্পনা করাও কঠিনতর ছিল। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি।

কিন্তু আজ তা আমাদের আবহমান গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আধুনিক যুগে চাকচিক্কের আধিক্যে হারিয়ে গেছে সেই ঢেঁকি ছাঁটা চাল। এখন সর্বত্রই অসংখ্য যান্ত্রিক ধান ভাঙার মেশিন ঢেঁকির সেই মধুময় ছন্দ কেড়ে নিয়েছে। বর্তমান পাড়ায় পাড়ায় ধান ভাঙা হাসকিং মিল এমনকি ভ্রাম্যমাণ মিল প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ভেঙে দেওয়ায় ঝকঝকে চাল, খাটনি কম ও সময় সাশ্রয় হওয়ায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। একসময় ঢেঁকি ছিল রাজারহাট উপজেলার গ্রাম-গঞ্জের চাল ও চালের গুঁড়া তৈরির একমাত্র মাধ্যম। রাজারহাটের বধূরা ঢেঁকিতে চাল ভাঙত গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম বাংলার সেই ঢেঁকিগুলো রাজারহাট উপজেলার গ্রামগুলোতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউপির সরিষা বাড়ি গ্রামে সাংবাদিক মোশারোফ হোসেনের উঠানে একটি ঢেঁকি পাতানো দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ঢেঁকির মালিক মোশারোফ হোসেন বলেন, ঢেঁকি ছাঁটা চালের পান্তা ভাত পুষ্টিমান ও খেতে খুব স্বাদ লাগে। বিশেষ করে ঢেঁকি ছাঁটা চালের ফিরনি-পায়েস ও পিঠাপুলি খুব স্বাদ হয়। মেশিনের তৈরি আটা দিয়ে এসব খাবারের তেমন কোনো স্বাদ হয় না। বর্তমান প্রজন্ম সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত। তাই কালের সাক্ষী হিসেবে উঠানে ঢেঁকি এখনো পেতে রেখেছি। বছরে দুই-একবার এই ঢেঁকিতে আটা তৈরি করে থাকি। তবে আগের দিনের মতো ঢেঁকির আর কদর নেই। কোনো একদিন হয়তো সেও ঢেঁকিটি তুলে ফেলব। বর্তমান যুগে কালের বিবর্তনে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির হয়তো আর দেখাই মিলবে না। আর কিছু দিন পরে নতুন প্রজন্ম হয়ত ঢেঁকির কথা শুনলে সেটি কী জিনিস, তা বুঝানো মুশকিল হয়ে পড়বে। হয়তো বিভিন্ন জাদুঘরে গিয়ে দেখা যাবে এই ঢেঁকি। আর এ যুগের ছেলে মেয়েদের ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে কৃষকের বাড়িতে ঢেঁকি কী ছিল। বর্তমানে এই ঢেঁকির গল্প শোনা যায় শুধু নানি-দাদিদের মুখে মুখে। আধুনিক সভ্যতার বিকাশে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। একসময় সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আর এখন গতিময় সভ্যতার যাত্রা পথে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষেই তা বিলুপ্ত হতে চলছে। আবহমান বাঙালির হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য ঢেঁকি শিল্প, বর্তমান ইতিহাসের সেই স্মৃতির পাতায় অমøান হয়ে থাকবে চিরদিন-চিরকাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close