নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বারবার কেন এই প্রাণহানি?

পুরান ঢাকার চকবাজারে গত বৃহস্পতিবারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, পুরান ঢাকায় আগুনে ভয়াবহ প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি থামানো যাচ্ছে না কেন? ৯ বছর আগে ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানায় একই ধরনের অগ্নিকান্ড প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ।

সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা পুরান ঢাকার মানুষ এখনও ভুলতে পারেননি। ওই অগ্নিকান্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক কারখানা এবং গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি। এ কারণে তাদের আবার পড়তে হলো আরেকটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠেছে পুরান ঢাকার এমন ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের মরণঝুঁকি কমছে না কেন? এর দায়ইবা কার ওপর বর্তায়। নিমতলীতে রাসায়নিকের আগুনে পুড়ে বহু মানুষের হতাহতের ঘটনার পর চকবাজারের একজন বাসিন্দা ক্যামেলিয়া চৌধুরী পুরান ঢাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি শুনলেও সেই নিমতলীর ঘটনার পর ৯ বছরেও সেসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তিনি দেখেননি। বরং ক্যামেলিয়া চৌধুরী চকবাজারে তার নিজের বাসভবন থেকে অল্প দূরত্বেই নিমতলীর ঘটনার মতো মারাত্মক পুনরাবৃত্তি দেখলেন। সরকার, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এমনকি স্থানীয় মানুষ-কেউই এমন পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না বলে তিনি মনে করেন। বাসাবাড়ির নিচে রাসায়নিক মজুদ রাখার কারণটা আগে দেখুন, আমি বাড়িওয়ালা, আমার আয় কম। আপনি আমাকে ৫ লাখ টাকা আগাম দিচ্ছেন। আমিও টাকার লোভে তা নিচ্ছি। উপরতলায় আমি বাড়িওয়ালা থাকছি, আমার ফ্যামিলি আছে। দোতলায় একটা জুতার কারখানা আর নিচে জুতা তৈরির জন্য আঠার গোডাউন। এটা ঝুঁকি। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিলেই তো আগুন লেগে যাবে। পুরান ঢাকার পুরোটা চিত্রই এ রকম। সরকার বা প্রশাসন থেকে এখানে আইন প্রয়োগ না করলে আগুনে পুড়ে মরার আশঙ্কা কমবে না। চকবাজারে নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তিটা মেনে নিতে পারছেন না পুরান ঢাকার মানুষ। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কি সব উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে? নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ে সরকার চাপের মুখে পড়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তখন পুরান ঢাকায় ৮০০ এর বেশি অবৈধ রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলো কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি এবং পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনকারী আবু নাসের খান বলছিলেন, পুরান ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকানের বেশির ভাগের নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই। এসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে তিনি মনে করেন। তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিভাবেও শক্তিশালী এবং এই এলাকার ভোটব্যাংক হিসাবে নানাদিকে প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে রসায়নিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় না। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদফতর তারাও সেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা এসব ব্যবসার লাইসেন্স দেয় বা তদারকি করে, তারাও সেটা সঠিকভাবে করেনি। এরা আসলে দায়ী।

পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলে বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন। কেউ লাইসেন্স নিলে তার শর্ত কি তারা পূরণ করছে?

লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা বা নিরাপত্তা সহ অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। দমকল বাহিনী একজন সাবেক কর্মকর্তা সেলিম নেওয়াজ ভূঁইয়া তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসায়ী যাদের লাইসেন্স আছে, তারাও শর্তগুলো পূরণ করেন না।

রাসায়নিক ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মুহিবুর রহমান নিমতলীর ঘটনার পর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, এখানে সরকারের দায় বেশি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আমার মনে হয়, সরকার এবং আমরা কেউই বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না।

নমতলীর ঘটনার সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন দিলীপ বড়–য়া। সে সময় তিনি অবৈধ রাসায়নিক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং এসব স্থানান্তরের কথা বললেও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু তিনি ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নন।

‘তখন তো অভিযান হয়েছিল। তারা নীতিগতভাবে ঠিক করেছিল, তারা চলে যাবে। আমরা জায়গা ঠিকে করে দেব। তারা তাদের অর্থায়নে সেটা তৈরি করবে। আমরা কেরানীগঞ্জে সে রকম জায়গাও ঠিক করেছিলাম। এর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো করতে গিয়ে আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর যারা কর্মকর্তা ছিলেন, তারা আর তা ফলোআপ করেননি। এ কারণে এ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এদিকে এখন আবার চকবাজারে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর সরকারের মন্ত্রীরা রাসায়নিক ব্যবসা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করাসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close