আলাউদ্দিন সোহাগ, পাইকগাছা (খুলনা)

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮

বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর বাড়ি কীটপতঙ্গের বসতঘর

একে একে পেরিয়ে গেল ১০টি বছর। কেউ মনে রাখেনি বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসীকে। প্রয়াত বীরাঙ্গনা গুরুদাসী কী পাবেন না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি! মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা তার সর্বস্ব লুটে স্বামী-সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এক দশক আগে হৃদয়ে কষ্ট নিয়ে তিনি দেহ ত্যাগ করেন। এই বীরাঙ্গনার শেষ আশ্রয়স্থল আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। তালাবদ্ধ তার বসতঘরে আশ্রয়স্থল হয়েছে কীটপতঙ্গের। রাতে আশপাশে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ আর নেশাগ্রস্তদের আড্ডা। অথচ তার শেষ অনুষ্ঠানে গঠন করা হয়েছিল বীরাঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ। আর তার বসবাসের বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয় ওই সময়। ১৯৭১ সাল, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের গুরুপদ মন্ডল পেশায় দর্জি হলেও সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। স্বাধীনতাকামী অত্যন্ত সহজ-সরল বিনয়ী একজন মানুষ। দুই ছেলে দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সংসার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি। রাজাকারদের ইন্ধনে পাক বাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়। একে একে পরিবারের সব সদস্যকে বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়। তার স্ত্রী গুরুদাসী মন্ডলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাক সেনাদের। নিজ স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এগিয়ে এলে গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের লাশ বীভৎস করে দেওয়া হয়। এরপর গুরুদাসীর কোলে থাকা দুধের শিশুকে মাতৃকোল থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাশে কাদা পানির ভেতরে। তারপর গুরুদাসীর ওপর হায়নারা পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। পাক হানাদাররা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী গুরুদাসীকে উদ্ধার করে। নিজ চোখের সামনে স্বামী, ছেলেমেয়ের মৃত্যু এবং পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে গুরুদাসী ততক্ষণে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে উদ্ধার করে তাদের হেফাজতে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে একসময় ফিরে আসেন স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত খুলনার পাইকগাছায়। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী ভিক্ষা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যান। হাতে ছোট্ট লাঠি, মানুষকে হাসতে হাসতে ভয় দেখানো আর হাত পেতে দুই টাকা চেয়ে নেওয়াÑ এভাবেই গুরুদাসীর দিন কাটতে থাকে। গুরুদাসী হয়ে ওঠেন এলাকার সবার কাছের মানুষ, পরিচিত মুখ। পরে বাগেরহাট জেলা পরিষদের প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, পাইকগাছা উপজেলার চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী ও তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিহির কান্তি মজুমদার কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় গুরুদাসীর বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। সেখানেই অযতেœ ও অভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন তিনি।

২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে কোনো একসময় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সকালে নিজ কক্ষে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখে প্রতিবেশীরা। গুরুদাসীর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুদাসীর আত্মত্যাগের কথা আজও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। সবাই ভুলে গেছে গুরুদাসীকে। তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যার কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখনো আসেনি।

পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী বলেন, গুরুদাসী মাসীকে মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিসহ তার শেষ স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হোক। ২০১৬ সালে ১২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক গেজেটে ৪১ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে মারা যাওয়া বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা উচিত।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close