শামীম আহমেদ

  ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

হারিয়ে যাওয়া পয়সার গল্প

শায়েস্তা খাঁর আমলে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এখন এক টাকায় বড়োজোর একটা চকলেট পাওয়া যায়। অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে এক টাকার ক্রয়ক্ষমতা এখন তলানিতে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে ১, ৫, ১০, ২৫ পয়সার কয়েন দিয়ে কোনো লেনদেন করাও সম্ভব নয়। কেননা এসব মুদ্রার অনেক উপরে পণ্য মূল্য।

১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৭ টাকা ৩০ পয়সা। এখন প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১১০ টাকা। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণেও মুদ্রার মানে অবমূল্যায়ন হয়েছে।

কিছুদিন আগে নবীগঞ্জের একটি দোকানে দুই টাকার মিনি শ্যাম্পু কিনতে গিলে দোকানি এক টাকার কয়েন নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার বক্তব্য এক টাকার কয়েন চলে না। পরে ১০ টাকার নোট দিয়ে শ্যাম্পু কিনতে হলো। তার কিছু দিন পরে ঢাকার এক দোকানে পরিচয় হয় এক ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি জানান, সিলেট অঞ্চলে এক, দুই ও পাঁচ টাকার কয়েন নাকি চলে না। তাই এসব কয়েন প্রতি ১০০-তে ৮০ টাকা দিয়ে ক্রয় করে তিনি ঢাকায় ১০৫ টাকা বিক্রি করেন। তার ব্যবসার আইডিয়া মন্দ নয়।

যা হোক ফিরে যায় আসল কথায়, শৈশবে ১০, ২৫, ৫০ পয়সার কয়েন দেখেছি তার মধ্যে ১০ পয়সায় কিছু পাওয়া না গেলেও ২৫ পয়সায় চকলেট কিনে খেয়েছি। সময়ের বিবর্তনে এসব কয়েন হারিয়ে গেছে। আর এসব হারিয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। রাজনৈতিকভাবেও সবচেয়ে স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক সূচক হচ্ছে এই মুদ্রাস্ফীতি। তাই সরকারেরই অর্থনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। একটি উদারণের মাধ্যমে বিষয়টি বলি, ধরি ২০২১ সালে ৫ কেজি চাল পাওয়া যেত ১০০ টাকায় মানে প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ২০ টাকা। কিন্তু ২০২২ সালে ওই ১০০ টাকায় ৪ কেজি চাল পাওয়া যায়। মানে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ৫ টাকা এই টাকার মান কমে যাওয়াও হলো মুদ্রাস্ফীতি। এ কারণে শায়েস্তা খাঁর আমলে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া গেলেও এখন তা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম চারটি কয়েন প্রচলন করা হয়। এগুলো হচ্ছে ৫, ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সা। তার মধ্যে ১, ৫ ও ১০ পয়সার কয়েন তৈরি করা হয়েছিল অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। অন্যদিকে ২৫ এবং ৫০ পয়সা ছিল ইস্পাতের তৈরি। এ সময় এক পয়সায় একদিকে জাতীয় প্রতীক এবং অন্যদিকে লাঙল ও শিল্প চাকার প্রতিকৃতি ছিল। তা ছাড়া ১০ পয়সার একদিকে জাতীয় প্রতীক অন্যদিকে পানপাতা, ২৫ পয়সার একদিকে জাতীয় প্রতীক, অন্যদিকে রুই মাছ, ৫০ পয়সার একদিকে জাতীয় প্রতীক অন্যদিকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রতিকৃতি ছিল। তারপর ১৯৭৪ সালে ১, ৫, ১০ ও ২৫ পয়সার মুদ্রা ফের বাজারে ছাড়া হয়। এ সময় এক পয়সার নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। একদিকে জাতীয় প্রতীক থাকলেও অন্যদিকে অলঙ্কারসমৃদ্ধ নকশা, পুষ্পশোভিত নিদর্শন যুক্ত করা হয়। ১৯৭৭ সালে এক পয়সা বাদে বাকি চারটি ধাতব মুদ্রা বাজারে আসে। এগুলোর মধ্যে পাঁচ পয়সার মুদ্রার নকশা অপরিবর্তিত থাকে। পরিবর্তন আসে অন্য তিনটি মুদ্রার নকশায়। ১০ পয়সার মুদ্রার একপাশে জাতীয় প্রতীক, অন্যপাশে একজন পুরুষ ও মহিলা কোলে বাচ্চাসহ একে অপরের অভিমুখে একই আসনে বসা, ২৫ পয়সার একদিকে জাতীয় প্রতীক এবং অন্যদিকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং ৫০ পয়সায় জাতীয় প্রতীক ছাড়াও ইলিশ, মুরগি, আনারস ও কলার প্রতিকৃতি যুক্ত করা হয়। জানা যায়, দেশের কাগজের নোটগুলো মূলত বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন থেকে ছাপানো হয়। তবে কয়েন বিদেশ থেকে তৈরি করে আনা হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে এক টাকা স্লোভাকিয়া থেকে, দুই টাকার জাপান থেকে এবং পাঁচ টাকার কয়েন ফিনল্যান্ড থেকে তৈরি করা হয়েছে। জানা গেছে, আগে ২ টাকা পর্যন্ত সরকারি নোট ছিল। ৫ টাকা থেকে ওপরের নোটগুলো ব্যাংক নোট। মূল্যস্ফীতির কারণে ২ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এখন সরকারের মুদ্রা হচ্ছে ৫ টাকার নোট পর্যন্ত। ৫ টাকা পর্যন্ত সব ধরনের নোট ও কয়েনের মালিক অর্থ মন্ত্রণালয়। ৫ টাকার ওপরে ১০ টাকা থেকে এর মানের মুদ্রাগুলো ব্যাংক নোট। এসব নোটে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষর। আর ৫ টাকা পর্যন্ত সরকারি নোটে থাকে অর্থ সচিবের স্বাক্ষর। তবে কয়েনে কোনো স্বাক্ষর থাকে না। ১, ২ ও ৫ টাকার কাগুজে নোটে অর্থসচিবের স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির কারণে এগুলোর আসলে তেমন কোনো ব্যবহার নেই। মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কয়েনেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী, এই কয়েনগুলো বাতিল বা অচল করা হয়নি এবং এগুলো এখনো চাহিদা অনুযায়ী বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close