সায়েদুল ইসলাম

  ০৯ আগস্ট, ২০২১

রেসকোর্স থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

যেভাবে ইতিহাসের সাক্ষী

৪০০ বছরের পুরোনো উদ্যান

রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এই উদ্যানটি এখন পরিচিত হলেও ইতিহাসে একাধিকবার এর নাম পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই উদ্যানের জন্ম হয় আসলে মোগল আমলে। ঢাকা স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী বইয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘সেই মোগল আমল (১৬১০) থেকেই বিশেষ এলাকা হিসেবে রমনার ইতিহাসের শুরু। ওই সময় বর্তমান নীলক্ষেত অঞ্চলে মহল্লা চিশতিয়ান এবং মহল্লা শুজাতপুর নামে গড়ে উঠেছিল দুটি আবাসিক এলাকা।’ ‘শুজাতপুর ছিল বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত। পুরোনো রেসকোর্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল চিশতিয়া। পুরো এলাকাটি ছিল মৌজা শুজাতপুরের অন্তর্গত। মৌজা শুজাতপুর নাম হয়েছিল রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতীর ভাই শুজাত খান চিশতীর নামে।’

ঢাকা স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘তাইফুর জানিয়েছেন, পুরোনো হাইকোর্ট ভবন থেকে নিয়ে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত মোগলরা তৈরি করেছিলেন বাগান, যার নাম ছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহী’ বা ‘বাদশাহী বাগান’। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, সে সময় রমনা ছিল বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সড়ক ভবন পর্যন্ত সাজানো বাদশাহী বাগান। এর বাইরে বর্তমানে যেখানে কলাভবন, কার্জন হল রয়েছে, সেখানে মোগলদের বেশ কিছু বাড়িঘর ছিল।

মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘এই দুটি এলাকা ও বাদশাহী বাগের মাঝখানের জায়গাটুকুু (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জুড়ে ছিল সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর। এ বিস্তৃত চত্বরের নাম হয়তো হয়ে গিয়েছিল রমনা। ফার্সি রমনার অর্থ সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর, ইংরেজিতে লন। পরবর্তী সময়ে শুজাতপুর, চিশতিয়া, বাগ-ই-বাদশাহী নাম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও রমনা নামটি গিয়েছিল টিকে, আর এ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকাটি।’

মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর ঢাকার অনেক অঞ্চল পরিণত হয়েছিল বিরান অঞ্চলে। অযত্নে-অবহেলায় রমনাও হয়ে পড়েছিল জঙ্গলাকীর্ণ।

কোম্পানি আমলে রমনার পরিবর্তন

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করেছেন, কোম্পানি আমলে রমনাকে উল্লেখ করা হয়েছে জঙ্গল হিসেবে, যেখানে বন্যজন্তুর কমতি ছিল না হয়তো। ‘হাইকোর্টের মাজার থেকে শাহবাগের মোড় পর্যন্ত জায়গাটি ছিল বোধহয় তখন এ রকম ঝোপঝাড়, জলাজঙ্গল, তার মাঝে উঁকি দিচ্ছে হাজি শাহবাজের মসজিদ, কালীবাড়ী। এর উল্টোদিকে গ্রিকদের কবরস্থান। চলার পথ। শুজাতপুর আর চিশতিয়া তখন স্মৃতি।’

ইংরেজ আমলে রমনা পুনরুদ্ধারে প্রথম হাত দিয়েছিলেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। ১৮২৫ সালে তিনি জেলখানার কয়েদিদের নিয়ে রমনা পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। তিন মাস চেষ্টার পর জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি ডিম্বাকৃতি একটি এলাকা বের করে আনেন। সেটার চারদিকে কাঠের রেলিং দিয়ে মি. ডস তৈরি করেছিলেন রেসকোর্স ময়দান।

মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য ডস রেসকোর্সের উত্তর-পূর্বদিকে তৈরি করেছিলেন একটি রাস্তা (বর্তমান নজরুল অ্যাভিনিউ)। তবে চার্লস ডস ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর রমনা আবার গাছপালায় ভরে ওঠে। ১৮৪০ সালের দিকে রাসেল মোরল্যান্ড স্কিনার ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন। সেসময় আবার রমনার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হতে শুরু করে। তখন অনেকে রমনার উত্তরাংশে বাগানবাড়ি তৈরি করতে শুরু করেন।

‘১৮৫৯ সালের সার্ভেয়ার জেনারেলের তৈরি ঢাকার মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, রমনাকে ভাগ করা হয়েছে দুভাবে রেসকোর্স আর বাকি অংশটুকু রমনা প্লেইনস। পরবর্তীকালে নবাব আহসানউল্লাহ এখানে একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন। নবাববাড়ির নাম ছিল এশরাত মঞ্জিল আর পুরো এলাকাটির নাম দিয়েছিলেন তারা শাহবাগ। একদিকে শাহবাগ, অন্যদিকে রেসকোর্স। নবাবরা এটিও পরিচালনা করতেন। নগরবাসীর এক অন্যতম বিনোদন ছিল ঘোড়দৌড় দেখা।’ ঢাকা স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী বইয়ে লিখেছেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন।

রমনা এলাকার আলাদা চাকচিক্য তৈরি হয় ১৯০৬ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ করা হয়। সেসময় বাংলা ও আসামকে নিয়ে গঠিত এলাকার প্রাদেশিক রাজধানী করা হয়েছিল ঢাকাকে। সেই এলাকার নাম দেওয়া হয়েছিল রমনা সিভিল স্টেশন।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর লিখেছেন, এখানে তৈরি করা হয়েছিল লাটভবন (পুরোনো হাইকোর্ট), কার্জন হল, সচিবালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরোনো বিল্ডিং, হাইকোর্ট ভবন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবন, চামেরি ভবন, সরকারি কর্মচারীদের আবাসস্থল হিসেবে মিন্টো রোড, হেয়ার রোড আর নীলক্ষেতের লাল রঙের বাড়িঘর। সেসময়ই রমনা পার্কেরও পত্তন করা হয়। রমনা এলাকা তখন মোটামুটি তিনভাবে বিভক্ত রমনা সিভিল স্টেশন, রমনা পার্ক আর রেসকোর্স।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বইয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর রমনায় নবাব এস্টেটের দান করা জমি এবং সরকারি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। কার্জন হল, পুরোনো ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ভবন, যা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের সময় তৈরি হয়েছিল, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া মিন্টো রোডের লাল বিল্ডিংগুলো, যেখানে এখন মন্ত্রীরা ছিলেন, সেগুলো ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের আবাসস্থল।

ইতিহাসের সাক্ষী রেসকোর্স

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি আলাদা দেশ হওয়ার পর রেসকোর্স ময়দান হয়ে উঠে রাজনৈতিক অনেক ঘটনার সাক্ষী। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘পঞ্চাশ দশকের মধ্যেই রমনার বিস্তৃত ময়দানের সীমানা মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। রমনার মূল মাঠ পরিচিত হয়ে উঠেছিল রমনা রেসকোর্স হিসেবে, আরেক অংশ রমনা পার্ক হিসেবে।’

১৯৪৯ সালে এই মাঠে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানেই তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওইদিনই তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে ছাত্রজনতা। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। এর আগের বছরের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন, কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চাপের মুখে তারা বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।

৭ মার্চ এই ময়দানেই বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই ময়দানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে এই ময়দানেই ১০ জানুয়ারি ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। কিছুদিন পরে ১৭ মার্চ আরেকটি জনসভায় ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ যে গণ-আদালত গঠন করেছিল, সেই আদালতও বসেছিল এই উদ্যানেই।

রেসকোর্স থেকে সোহরাওয়ার্দী

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ‘স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত রমনার রেসকোর্স হয়ে উঠেছিল হতশ্রী এক ময়দান, যার এক পাশে ছিল রেসকোর্সের কাঠের ক্ষয়ে যাওয়া বিবর্ণ রেলিং, অন্যদিকে দাঁড়িয়েছিল জীর্ণ কালীমন্দির,’ ঢাকা স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী বইয়ে লিখেছেন মুনতাসীর মামুন। এরপর থেকে এই জায়গাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামেই পরিচিত।

পরবর্তী সময়ে এই উদ্যানের খোলা অংশে গাছপালা লাগানো হয়। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ময়দানের একটি অংশে তৈরি করা হয় শিশুপার্ক। স্বাধীনতার আগেই অবশ্য আরেকটি অংশে বর্তমানের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসে আবার ময়দানের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক ঘটনাবলি তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৯ সালে ময়দানে শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয়। সেই সঙ্গে পাশেই যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে স্বাধীনতাস্তম্ভ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

২০১০ সালের ৭ জুলাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের হাইকোর্ট সরকারের প্রতি নির্দেশনা সম্পর্কিত একটি রায় দিয়েছে। একটি কমিটির মাধ্যমে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিসৌধ স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে এ রায়ে। বর্তমানে এই উদ্যানের ঐতিহাসিক দিকগুলো তুলে ধরতে বাংলাদেশের সরকার ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে।

ছবি : সংগৃহীত

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close