রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৮ আগস্ট, ২০২২

বিশ্লেষণ

রোহিঙ্গা ইস্যু নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি

রোহিঙ্গা ইস্যু একটি কঠিন ও জটিল সমস্যা। দিন যত গড়াচ্ছে ততই যেন এর সমাধানের পথ দূরে সরে যাচ্ছে। সম্প্রতি উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয় শিবিরেও প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গার পৃথক সমাবেশ হয়েছে। তা ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফের চৌত্রিশটি আশ্রয় শিবিরের সব কটিতে ছোট ছোট ত্রিশটির বেশি সমাবেশ করে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার দাবি জানায় রোহিঙ্গারা। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তিন দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। তখন রোহিঙ্গাদের দাবি ছিল, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। লম্বাশিয়া আশ্রয় শিবিরের সমাবেশের স্লোগান ছিল বাড়ি চলো এবং তারা বলছে আমরা এই দেশে আশ্রিত, এটি আমাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা নয়। দিন যত বাড়ছে, সমস্যা তত প্রকট হচ্ছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে থাকতে চাই না। আমরা নিজের অধিকার নিয়ে দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। তাই বাড়ি চলো আন্দোলন।

যে যাই বলুক, এটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় জাতীয় সমস্যা। সফল নিদর্শন ও আলামত থাকার পরও ২০১৭ সালের আগে যেমন কেউ বুঝতে পারেনি আজকের অবস্থা, তেমনি দ্রুত একটা সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা ফেরত না গেলে আগামী পাঁচ-সাত বছরের মাথায় এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য কতখানি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। মিয়ানমারের নাগরিক, ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু চার বছরের বেশি সময় ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সবাই একটু সরব হয়েছে বলেই চার বছর ধরে বলছি। আসলে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর সংঘাত-সংঘর্ষ কয়েক শ বছরের পুরোনো, আর বাংলাদেশ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে, তা-ও প্রায় ৪৩ বছর হয়ে গেল।

২০১৭ সালের অনেক আগে থেকেই প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে এসে অবৈধভাবে কক্সবাজারে অবস্থান করছিল। ১৯৭৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারই বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। আজ বাংলাদেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ, যা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের জীবন বাঁচিয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শরণার্থীরা এক বছরের মধ্যে দেশে ফিরতে পেরেছিল, কিন্তু রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি তার চেয়ে ভিন্ন। তবু তারা সুযোগ পেলেই বারবার বলে যে, তারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই চায় না। তবে সহজাতভাবেই তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে যে তাদের অধিকার, প্রয়োজনীয় পরিষেবা, সুষ্ঠু নিবন্ধন ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা না নিয়েই যদি তারা ফেরত যায়, তাহলে তাদের জীবন আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে রেকর্ডসংখ্যক ১০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে। একাধিক শরণার্থী সংকটের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে বেশির ভাগ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি ও পরিবারের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আদতে খুব কম।

এই শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ১১ লাখ বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় আছে। তাদের বেশির ভাগই প্রায় পাঁচ বছর ধরে এখানে বসবাস করছে। তাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে কিছু মৌলিক বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, যেমন নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় পরিষেবা, আবাসন, জীবিকার সুযোগসহ অন্যান্য মৌলিক মানবাধিকার, যেমন চলাচলের স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর অন্য মানবিক অংশীদারদের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারের অন্যান্য স্থানে উপস্থিত রয়েছে। সেসব জায়গায় তারা কাজ করছেন। তবে কিছু বাস্তবতা মেনে নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার কারণে রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে এখনো জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

সরকার, মানবিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোকে অবশ্যই এ সহায়তা বজায় রাখতে হবে; তবে শরণার্থীদের শিক্ষা, তাদের দক্ষতার বিকাশ ও জীবিকার সুযোগ নিয়েও কাজ করতে হবে। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে, টেকসই প্রত্যাবাসনের পর এগুলো তাদের নিজ সমাজে পুনর্বাসনে দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য করবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা যে দক্ষতা অর্জন করবে, সেটি তারা কাজে লাগাতে পারবে মিয়ানমারে। শরণার্থী শিবিরে তাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের ক্ষেত্রেও এটি দরকারি; কারণ এর মাধ্যমেই তাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা বাঁচিয়ে রেখে অর্থবহ জীবন দেওয়া সম্ভব। ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে তারা পাচ্ছে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও জীবিকার সুযোগ, যা তাদের করে তুলছে আরো যোগ্য ও প্রত্যয়ী।

ইউএনএইচসিআর ও জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় স্থানীয় এনজিওগুলো দক্ষতা বিকাশ ও জীবিকা, যেমন কৃষি, মাছ ধরা বা টেইলারিংয়ের সুযোগ দিচ্ছে। ভাসানচরে জীবিকা-সংশ্লিষ্ট কাজগুলো কক্সবাজারের শিবিরগুলোয় সমানভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে ভৌগোলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে। শরণার্থী শিবিরগুলোয় প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো অনেক দূর এগিয়েছে এবং একটি পরিবেশবান্ধব কর্মপরিকল্পনা ক্যাম্পজুড়ে প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধার করেছে। তবে এটি বজায় রাখার জন্য আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, যেন জ্বালানি কাঠের বিকল্প শক্তির উৎসগুলো, বিশেষ করে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস, শরণার্থী পরিবার ও তাদের আশপাশের স্থানীয় পরিবারগুলোকে নিয়মিত সরবরাহ করা যায়। উপরন্তু বন্যা, ভূমিধস ও অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্যোগের প্রস্তুতি ও মোকাবিলার জন্য আমাদের অবশ্যই উভয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বিশ্বে একাধিক মানবিক সংকটের—বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইউক্রেনের কারণে একটি গুরুতর ঝুঁকি রয়েছে যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আমাদের অবশ্যই রোহিঙ্গাদের চাহিদা তুলে ধরার মাধ্যমে বৈশ্বিক মনোযোগ ও সমর্থন বজায় রাখার সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের অবশ্যই পৃথিবীকে দেখাতে হবে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আমাদের কাজ সুসমন্বিত, কার্যকর ও প্রয়োজনীয়। আমাদের অবশ্যই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, দাতা সংস্থা ও সুশীলসমাজের নেতৃত্বকে তুলে ধরতে হবে। তারাই আমাদের সব কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের অবশ্যই দাতা তহবিলে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং দাতা, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারত্ব জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি এখন আগের চেয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সংহতি ও অব্যাহত সমর্থনের জন্য আবেদন জানাই। আর আমি এখনো আশা করি, মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনে এবং সেখানে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পেতে আমাদের সবার সম্মিলিত পদক্ষেপ অব্যাহত থাকা খুবই জরুরি। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে বাংলাদেশের ওপর অভিঘাতের স্বরূপ বহুমুখী। ক্যাম্পগুলো ঘিরে মানব পাচারসহ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের বিস্তার ঘটছে ভয়াবহভাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্বুদ্ধ করে রোহিঙ্গা যুবকদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা সম্পর্কে সবাই জানে। ক্যাম্পের ভেতরে স্বার্থান্বেষী এনজিও, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, মাদক, মানব ও অস্ত্রপাচার গোষ্ঠী এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জঙ্গি, সন্ত্রাস, উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে শুধু বাংলাদেশ নয়, চীন ও ভারত ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইন অঞ্চলে যেসব অবকাঠামো তৈরি করেছে তার নিরাপত্তা সব সময় হুমকির মধ্যে থাকবে। যেকোনো বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বাংলাদেশের জন্য জরুরি, সময়ক্ষেপণ ঠিক হবে না। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সরকার এবং তার সঙ্গে জোরালোভাবে ট্র্যাক টু ও ট্র্যাক থ্রি কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে এবং আমাদের অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই মর্মে যে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে বাংলাদেশ কারো পক্ষে বা বিপক্ষে নয়।

শুধু ২০১৭ থেকে নয়, ১৯৭৮ সাল থেকে সংঘটিত ঘটনাবলিকে ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে উভয় দেশকে পরবর্তী কোর্স অব অ্যাকশন নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমস্যাটি আন্তর্জাতিক, কিন্তু ভিকটিম বাংলাদেশ। সমস্যা সমাধানে সফল হতে হলে আত্মপর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনা দরকার। আমাদের বোঝা উচিত ছিল এবং এখনো বুঝতে হবে মিয়ানমার রাষ্ট্র চালায় সে দেশের সেনাবাহিনী। তাদের কাছে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা ও উন্নতির চেয়ে ক্ষমতায় থাকা জরুরি। ১১ লাখ নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি থেকে উৎখাত হওয়া ক্ষুব্ধ মানুষ, যার মধ্যে উঠতি বয়সি ও যুবক শ্রেণি হবে এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ প্রায় আড়াই-তিন লাখ, বিপর্যয়ের ক্ষুব্ধতায় তারা প্রত্যেকেই হয়ে উঠতে পারে একেকটি স্বতন্ত্র বোমা। হতাশ ও সর্বহারা মানুষের পক্ষে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব। যত যা-ই হোক, বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থেই কখনো জঙ্গি, সন্ত্রাসী বা অন্য দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। এ ব্যাপারে সরকারের জিরো টলার‌্যান্সনীতি রয়েছে। কিন্তু এত বিশালসংখ্যক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী, যেখানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য এনজিও এবং বহু পক্ষ সংগত কারণেই জড়িত, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের শতভাগ সদিচ্ছা থাকলেও সব অপতৎপরতা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সম্ভব নয়। সুতরাং মিয়ানমার সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। দিন যত যাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি ততই বাড়বে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তমত,রোহিঙ্গা,বাংলাদেশ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close