reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০২ মে, ২০১৯

কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াই তাদের কাজ

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া পেশাদার ও সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রের ১৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৪ (র‌্যাব) এর একটি দল। তারা প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর।

তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল পেশাদার প্রতারকচক্রের ওই ১৫ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যাক্তিরা হলেন- মো. নুরুল ইসলাম (৩৭), মো. মিনার মিয়া ওরফে চৌধুরী (৪২) মো. মিজান (৫০), মো. তোফাজ্জল করিম তানভীর (৪১), আক্তার ফারুক (৪৩), (৬) মো. রাজু (৪১), মো. গোলাম মোস্তফা শাকিল (৪২), মো. শাকিল খান ওরফে সৈকত (৩০), জাহাঙ্গীরুল আবেদীন ওরফে বাবলু (৪৮), আজগর আলী হাওলাদার (২৭), মো. সিরাজুল ইসলাম (৪৫), মো. শামিম মিয়া (৪০), অজয় চাকী (৪০), মো. হারুন উর রশিদ (বাদল) (৪৭) ও মো. তুষার আহমেদ (২০)।

এ সময় প্রতারণার কাজে ব্যবহত নথিপত্র ও সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া অনেক আসামির বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় এক বা একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

র‍্যাব জানায়, প্রতারকচক্রের প্রতিটি সদস্য প্রতারণাকে তাদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় তাদের এ সংগঠনের একটি সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। তারা প্রতারণার এই পেশাকে মিডিয়া বিজনেস বলে থাকে এবং নিজেদেরকে মিডিয়া ম্যান বা মিডিয়ায় কাজ করেন বলে পরিচয় দেন। তাদের গ্রুপে সাধারণত পাঁচটি স্তরে সদস্য থাকে।

এজেন্ট : প্রতারকচক্রটির মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীরা হচ্ছেন এজেন্ট। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে টার্গেট কিংবা ভিকটিমকে চিহ্নিত করেন। এক্ষেত্রে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যবসায়ীদেরকে লক্ষ্য করে কার্যক্রম শুরু করেন তারা। তিনি টার্গেট ব্যক্তির কাছে বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। পরিচয়ের এক পর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তিকে ব্যবসা সংশ্লিষ্ট মালামাল বিক্রয়ের লোভনীয় অফার দেন। এরপর টার্গেট ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে তাকে প্রতারকচক্রের অফিস বা কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তিনি।

স্থানীয় ব্রোকার : স্থানীয় ব্রোকার প্রতারকচক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। এজেন্ট যখন টার্গেট ভিকটিমকে তাদের মালামাল দেখানোর জন্য নিয়ে যান তখন স্থানীয় ব্রোকাররা নিজেদেরকে সরকারি দলের উচ্চ পদের নেতা অথবা কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাই, নিকট আত্মীয় কিংবা পরিচিত বলে পরিচয় দেন।

রিসিপশন : প্রতিটি প্রতারণার অফিসের রিসিপশনে একজন সুন্দরি, স্মার্ট ও শিক্ষিত মেয়ে দায়িত্ব পালন করেন। টার্গেট /ভিকটিমকে গ্রাহক অফিসে আনার পর রিসিপশনের দায়িত্ব পালন করা মেয়েটি আপ্যায়ন ও সৌহার্দপূর্ণ আচার-আচরণে তার বিশ্বাসযোগাতা অর্জনের চেষ্টা করেন।

ম্যানেজার : ম্যানেজার প্রতারণাচক্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেন। টার্গেট ব্যক্তিকে অফিসে আসার পর ম্যানেজার সুকৌশলে তাদের কোম্পানি ও মালিক সম্পর্কে বিভিন্ন রকম প্রশংসামূলক কথা-বার্তা বলেন। আপ্যায়ন ও সৌহার্দপূর্ণ আচার-আচরণের মাধ্যমে টার্গেট/ভিকটিমকে মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের ভুয়া চুক্তিনামা তৈরি করেন।

মালিক (এমডি/চেয়ারম্যান) : মালিক (এমডি/চেয়ারম্যান) প্রতারণাচক্রের একজন অন্যতম হোতা। তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন নামিদামি এলাকায় অফিস ভাড়া করে আসবাবপত্র ক্রয় করে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল নিয়োগ করে একটি আধুনিক রুচি সম্মত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আদলে ভুয়া অফিস সাজিয়ে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন।

প্রতারণার কৌশল :

এই প্রতারণা চক্রের কৌশলগুলো সম্পর্কে র‍্যাব বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে জানায়,

শাটিং ফেব্রিক্স : প্রতারকচক্রের এজেন্ট বিভিন্ন কাপড় ব্যবসায়ীদেরকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করেন। তারা প্রথমে ভুয়া কোনো গার্মেন্স ফ্যাক্টরির এজেন্ট হিসেবে ওই ব্যবসায়ীদের দোকানে গিয়া তাদের প্রয়োজন মতো কম দামে শাটিং কাপড় ক্রয়ের জন্য লোভনীয় অফার দেন। এরপর তারা জানান, তাদের কোম্পানির কয়েক হাজার গজ কাপড় বিভিন্ন স্থানে ফ্যাক্টরির গোডাউনে রাখা আছে। ব্যবসায়ীরা তাদের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হলে তারা কোনো নামিদামি প্রতিষ্ঠানের গোডাউনে রাখা শাটিং ফেব্রিক্স গোডাউনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সোগসাজসে সেই মালামাল বিক্রি হবে বলে দেখান।

পরবর্তীতে ঢাকায় তাদের প্রতারণার অফিসে মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করে এবং মালামালের মূল্য বাবদ অগ্রিম টাকা নিয়ে ভুয়া কোম্পানির মানি রিসিট দেন। একপর্যায়ে পর্যাপ্ত টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার পর চক্রটি তাদের ফোন বন্ধ করে দেন।

স্ক্রেব কিংবা লোহার গর্দা : প্রতারকচক্রের সদস্যরা বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির এজেন্ট পরিচয় দিয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যবয়ীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসায়ীক উপকরণ ক্রয়ের জন্য লোভনীয় অফার দেন। এরপরে বিভিন্ন কোম্পানির বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত মালামাল নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজনের যোগসাজসে নিজেদের মালামাল হিসেবে দেখিয়ে টার্গেট ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করেন। এরপর টার্গেট ব্যক্তি প্রতারকচক্রের অফিসে আসলে রিসিপশনের দায়িত্ব পালন করা সুন্দরি, স্মার্ট ও শিক্ষিত মেয়েরা আপ্যায়ন করে তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।

পাওয়ার কয়েন : প্রতারকচক্রের সদস্যরা দেশের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যবসায়ী বা উচ্চ পদস্থ চাকরীজীবিসহ ধনাট্য ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতারকচক্রের এজেন্টরা ভিকটিমদের জানান যে, অতি পুরানো যুগের বিশেষ ধরনের কয়েন মহামূল্যবান, যার মূল্য প্রায় কয়েকশত কোটি টাকা। কয়েনগুলো বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন, প্রমাণ স্বরূপ তারা ভুয়া রিপোর্ট দেখান, যা আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করা যায়। কয়েনের ওপর তারা বিশেষ ধরনের ক্যামিকেল প্রয়োগ করে তার ওপর ২৪/২৫ পিস ধান রাখেন এবং সেগুলো পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রং ধারণ করে এক পর্যায়ে ধুলায় পরিণত হয়। এ ধরনের কয়েন তাদের টার্গেট ব্যক্তিদের কম দামে ক্রয় করিয়ে বেশি দামে বিক্রির প্ররোচনা দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। টার্গেট ব্যক্তিকে ভুয়া পাওয়ার কয়েন ক্রয় করানোর পর আবার প্রতারণা চক্রের সদস্যদের মধ্যে একজন পাওয়ার কয়েন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ক্রয় করা পাওয়ার কয়েনটি সাধারণ কয়েন হিসেবে চিহ্নিত করেন। এজন্য তিনি মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন।

ম্যাগনেটিক পিলার : প্রতারকচক্রের সদস্যরা দেশের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যবসায়ী বা উচ্চ পদস্থ চাকুরীজীবিসহ ধনাট্য ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতারক চক্রের এজেন্টরা টার্গেট ব্যক্তিদের জানান যে, অতি পুরানো যুগের বিশেষ করে ব্রিটিশরা মাটির নিচে সীমানা নির্ধারণী ম্যাগনেটিক পিলার পুতে ছিলেন তা মহামূল্যবান। এর মূল্য প্রায় কয়েকশত কোটি টাকা। ম্যাগনেটিক পিলারগুলো বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন, যা বিদেশে অনেক দামে বিক্রি করা যায়। ম্যাগনেটিক পিলার টার্গেট ব্যক্তিদের কম দামে ক্রয় করিয়ে বেশি দামে বিক্রয়ের প্ররোচনা দিয়ে প্রতারণা করে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে চক্রটি।

তক্ষক : প্রতারকচক্রের সদস্যরা দেশের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যবসায়ী বা উচ্চ পদস্থ চাকরীজীবিসহ ধনাট্য ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করেন। চক্রের এজেন্টরা টার্গেট ব্যক্তিদের জানান যে, যদি ১৫ ইঞ্চির বড় এবং তক্ষকের ওজন কমপক্ষে ২৫৩ গ্রাম হলে ওই তক্ষকের দাম একশ থেকে দুইশ কেটি টাকা।

প্রতারকচক্রের সদস্যরা টার্গেট ব্যক্তিদের কম দামে তক্ষক ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করার লোভনীয় অফার দেন। টার্গেট ব্যক্তি যখন তক্ষক ক্রয় করার জন্য রাজি হন তখন প্রতারকচক্রের সদস্যরা কৌশলে ছোট ভিডিওর মাধ্যমে তক্ষক দেখান এবং টার্গেট ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। আবার কখনো কখনো টার্গেট ব্যক্তি প্রতারকচক্রের সদস্যদের কাছ থেকে তক্ষক কেনার পর প্রতরকচক্রের সদস্যদের মধ্যে একজন তক্ষক বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর টার্গেট ব্যক্তির কেনা তক্ষকটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানান যে, তক্ষকটি বিদেশে বিক্রির উপযুক্ত নয়। আবার কখনো কখনো যদি সঠিক মাপের ও ওজনের হয় তখন প্রতারকচক্রের সদস্যরা সুকৌশলে তক্ষকটি মেরে ফেলে।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোটি টাকা,হাতিয়ে নেয়া
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close