ইমরান হোসেন সুজন, নবাবগঞ্জ (ঢাকা)

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

তামীরের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠার গল্প

প্রতিভাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। দেশসেরা বডি বিল্ডার তামীর আনোয়ারের প্রতিভাকেও কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। মফস্বল থেকে উঠে আসা এই যুবকের খ্যাতি এরই মধ্যে দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছেন লাল-সবুজের পতাকা, উজ্জ্বল করেছেন দেশের ভাবমূর্তি। তাইতো তামীরের নামটাই হয়ে গেছে ‘মিস্টার বাংলাদেশ’!

এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় সেরা এই বডি বিল্ডারের জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের উত্তর বাহ্রা গ্রামে। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মো. ইকলাচ উদ্দিন ও গৃহিণী রহিমা দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তামীর। ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি তার অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। তবে অন্য খেলার চেয়ে শরীর গঠনের প্রতি তার টান ছিল একটু বেশি। নিজেকে স্মার্ট ও ফিট রাখাকেই প্রাধান্য দিতেন তামীর। তাই তো শখের বসে বডি বিল্ডিংয়ে নাম লেখালেও এখন এটাকে পেশা হিসেবেই বেছে নিয়েছেন।

চারবার দেশসেরা বডি বিল্ডারের খেতাবজয়ী তামীরের যাত্রা শুরু ২০০১ সালে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়। তখন তিনি এইচএসসির শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর সেখানকার জিমনেসিয়ামেও ভর্তি হন। ২০০৬ সালে প্রথমবার শরীর গঠনের প্রতিযোগিতামূলক আসরে অংশ নেন তিনি। সেবার স্বাধীনতা দিবস প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন তিনি। এর দুই বছর পরেই জাতীয় পর্যায়ে নিজের শরীর প্রদর্শনের সুযোগ পান তামীর। ওইবার পঞ্চম স্থান অর্জন করলেও পরের পাঁচ আসরের তিনবারই দ্বিতীয় হয়েছেন তিনি।

এতেও তৃপ্ত হতে পারেননি তামীর। ‘দ্বিতীয় হতে পারলে প্রথম হতে পারব না কেন’- এই সাধনা নিয়ে এগোতে থাকেন। আগের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে শুরু করেন। তার সেই ঘাম ঝরানো পরিশ্রম বৃথা যায়নি। ২০১৪ সালে সাতটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সবকটিতে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন থেকে এখন পর্যন্ত শরীর গঠনের সর্বোচ্চ খেতাব ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ তার দখলে। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬Ñ টানা তিনবার এ খেতাব অর্জন করেন তামীর। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল। সর্বশেষ ২০১৯ আসরেও সব প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে খেতাব ধরে রাখেন।

বিদেশ বিভূঁইয়েও সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তামীর আনোয়ার। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপের ক্ল্যাসিক ফিজিক ক্যাটাগরিতে জিতেছেন ব্রোঞ্জ পদক। এছাড়া ভারতে অ্যামেচার মিস্টার অলিম্পিকে দ্বাদশ স্থান অর্জন করেছেন। তামীরের ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য এসেছে গত বছরের জুলাইয়ে। চীনে হার্বিনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান বডি বিল্ডিং অ্যান্ড ফিটনেস চ্যাম্পিয়নশিপে দেশকে রোপ্য পদক এনে দিয়েছেন তিনি। এশিয়ান অলিম্পিকে বাংলাদেশি বডি বিল্ডার হিসেবেও তিনি প্রথম পদক অর্জন করেছেন। মহাদেশীয় এই টুর্নামেন্টে পদক জয় বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য বিরল এক ঘটনাই বটে।

কদিন আগে তামীরের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় তার গ্রামের বাড়িতে। প্রতিদিনের সংবাদকে তামীর জানান, ‘আসলে আমি শখের বসেই বডি বিল্ডিংয়ে আসি। লেখাপড়া শেষ করার পর ভালো কোথাও চাকরি করব এমন ইচ্ছাও ছিল। যেহেতু আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি, তাই এখন এই নেশাটাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। এখন বসুন্ধরার একটি জিমে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘দুই থেকে তিন বছর আগেও বাংলাদেশে বডি বিল্ডিং এত জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু আমরা যারা আন্তজার্তিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা বেশ কয়েকটি পদক এনে দিয়েছি। তার কারণে বডি বিল্ডিংটা এখন অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আশা করি আগামী কয়েক বছরে আমাদের বডি বিল্ডিং আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। দেশের যেকোনো শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় আমি বাংলাদেশ আনসারের হয়ে অংশগ্রহণ করি।’

যুব সমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে শরীর চর্চার বিকল্প নেইÑ এমনটাই মনে করেন তামীর, ‘যুবকরা বেশি বেশি শরীর চর্চায় মনোযোগী হলে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা যেত। বর্তমানে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই যেভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। কিন্ত এসব বিপথগামী তরুণ ও যুবকদের জিমে আনতে পারলে তারা মাদক থেকে দূরে সরে আসত। কারণ যারা নিজের শরীরকে ভালোবাসে, তারা মাদক গ্রহণ করে না।’

বাবা ইকলাচ উদ্দিনও যারপরনাই গর্বিত ছেলেকে নিয়ে। তার ভাষ্য, ‘আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ইচ্ছা ছিল সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে ভালো চাকরি করবে। কিন্তু যখন দেখলাম ছোট ছেলে (তামীর) বডি বিল্ডারে নাম লেখাল, তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। সে মাস্টার্স পাস করলেও পেশা হিসেবে বডি বিল্ডিংকে বেছে নেওয়ায় ওর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় কত রাত নির্ঘুম কেটেছে তার হিসাব নেই। তবে তামীরের ইচ্ছাশক্তি ও বড় ছেলের উৎসাহে ওর সাফল্য আমার দুশ্চিন্তাকে স্বপ্নে পরিণত করেছে। ছেলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সবার মতো আমিও খুশি। দোয়া করবেন আমার ছেলেটা যেন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে নবাবগঞ্জের নাম উজ্জ্বল করতে পারে।’

তামীরের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি বড় ভাই স্কুল শিক্ষক লুৎফর রহমান। ছোট ভাইয়ের ইচ্ছাশক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে সবসময় তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন বলে জানালেন তিনি, ‘ছোট বেলা থেকেই তামীর ভালো ক্রীড়াবিদ। দৌড়ে সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করত সে। ও যখন জিমে ভর্তি হলো আমি সমর্থন করেছি। কারণ আমি জানতাম ও ওর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। অনেকে আমার ভাইকে নিয়ে কটু কথা বলত, তবে আমি ওর পক্ষে ছিলাম। আজকে ওর যে প্রাপ্তি, এটা ওর কঠোর পরিশ্রমের ফল। আমি ওকে নিয়ে গর্বিত।’

এত সাফল্যের পরও দেশসেরা বডি বিল্ডার তামীর হাল ছাড়ছেন না। এখন তার স্বপ্ন বিশ্বসেরা হওয়ার। সেজন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তা চাইলেন তিনি। তামীর মনে করেন, সবার সমর্থন পেলে দেশের বডি বিল্ডাররা নিজেদের যোগ্যতার দ্যুতি ছড়াবেন বিদেশের মাটিতেও। তার হাত ধরে জন্মস্থান নবাবগঞ্জের নাম এই গ্রহের সবাই জানুক, এটাই প্রত্যাশা এই অসাধারণ মানবের। তামীর সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পারলে বাংলাদেশেরই তো লাভ। তবে তা-ই হোক!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close