রুমান হাফিজ

  ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

স্মৃতি

রগচটা গম্ভীর স্বভাবের জিলান। তার বয়স আর কতইবা হবে। সবেমাত্র ষোলতে পা দিয়েছে। রগচটা স্বভাবের কারণে গ্রামের অনেকেই তাকে ‘জিওল’ বলে ডাকে। এমনকি তার একেবারে প্রিয় বন্ধু আবিদও-

-কিরে দোস্ত, তোকে সবাই জিওল বলে ডাকে, তুই রাগ করিস না?

আবিদের প্রশ্ন শুনে জিলান হাসে।

-আরে না দোস্ত, সব কথায় রাগলে কি আর চলে?

-ঠিক আছে, তাহলে আর কখনো রাগ করবি না, কেমন?

জিলান সায় দেয়, -হুম।

জিলানের রাগ বেশি হলে কি হবে, পড়ালেখা করে প্রচুর। স্কুল ফাঁকি সে তো অনেক দূরের কথা। তাছাড়া কারো কোন ক্ষতি করেছে কিংবা কারো সাথে বেয়াদবি করেছে-এমন কথা কেউ বলতে পারবে না।

শুধু রাগ উঠলেই একটু ঝামেলা হয় আর কি!

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বিকেলবেলা তেমন একটা খেলাধুলো করে না। বন্ধু আবিদকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর তীরে। সেখানে বসে দুজন গল্প কিংবা পড়ালেখা নিয়ে সময় পার করে। কখনো কখনো ওরা বড়শি নিয়ে যায় নদীতে মাছ ধরতে, হঠাৎ বড় বড় মাছ পেয়েও যায়। মাছ পেলে তখন দুজনের কী যে খুশি!..

দুই.

প্রতিদিনের মতো আজো ঘুম থেকে ওঠে জিলান। সকালের সব কাজ শেষ করে স্কুলে যাওয়ার জন্য পড়ার টেবিল থেকে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই জিলানের বাড়িতে প্রবেশ করে আবিদের ছোট ভাই ইমরান। ইমরানকে দেখতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে জিলান।

-আরে ইমরান যে! কী মনে করে এতো সকালে, বস বস।

ইমরান কোন কথা বলে না। ওর মুখটা বিমর্ষ দেখে ভয় পেয়ে যায় জিলান। ইমরান কিছু বলার আগেই সে আবারও প্রশ্ন করে-

-ইমরান কী হয়েছে? কিছু বলছ না যে, খারাপ কিছু হয়েছে?

জিলানের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া। কোনো কথা না বলেই ইমরান জিলানের হাত ধরে তাদের বাড়ির দিকে পথ ধরে। ইমরানের কর্মকান্ডে এবার থ হয়ে যায় জিলান। মনের মধ্যে ভয়টা আরো বাড়তে থাকে।

জিলান আবিদের বাড়ি পৌঁছে বাড়িভর্তি মানুষের ভিড় লক্ষ করে। ঘর থেকে ভেসে আসছে করুণ সুরে মহিলাদের আহাজারি।

কিছুই বুঝতে পারছে না জিলান। এদিক সেদিক তাকেতেই হঠাৎ চোখ পড়ে উঠোনের মধ্যখানে সাদা কাপড় মোড়ানো খাটিয়ার দিকে। ব্যস, এক দৌড়ে আবিদের ঘরে প্রবেশ করে জিলান। তাকে দেখে আবিদের বাবা এনাম সাহেব কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কাছে ডাকলেন। অতঃপর উঠোনে রাখা খাটিয়ার কাছে নিয়ে লাশের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখালেন। লাশে চোখ রাখতেই ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসে। আরে! এ যে তার প্রাণাধিক বন্ধু আবিদ।

বন্ধুর বিয়োগে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জিলান। পাশে থাকা আবিদের বাবাও কেঁদে দিলেন। ঘরের ভেতরের কান্নার আওয়াজ যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জিলান অঝোরে কাঁদছে। হঠাৎ সে মূর্ছা গেল।

তিন.

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে জিলান। চোখ মেলতেই দেখল তার পাশে বাবা-মা আর একজন ভদ্রলোক। এছাড়াও আরো অনেক আত্মীয় দেখতে এসেছেন তাকে। সবাইকে চিনলেও এই ভদ্রলোকটাকে সে চিনতে পারছে না। কে হতে পারে? এমন চিন্তা করছিল। হঠাৎ সেই ভদ্রলোক বললেন-

-বাবা জিলান, কেমন আছ তুমি? কেমন লাগছে এখন?

কিছু বলতে পারে না, অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ পর ফের চোখ খুলে দেখে পাশে কেউ নেই, শুধুমাত্র সেই ভদ্রলোক বসা। আবারও একই প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক। জিলান কোনোরকম উত্তর দেয়। তারপর ভদ্রলোক তার পরিচয় খুলে বলতেই সে চিনতে পারে। এ যে তার সুমন মামা! সেই ছোটবেলায় দেখেছিল। তাকে তিনি কত ভালোবাসতেন। মামার পিঠে চড়ে ঘোড়া চড়ার স্বাদ মিটিয়েছিল কতবার। কিন্তু মামা বিদেশে চলে যাওয়াতে আর দেখা বা যোগাযোগ হয়নি। আর মামা যে দেশে ফিরেছেন সে কথা তো কেউ তাকে বলেনি। হয়তো সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগে অনেক বড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেছে সে। প্রাণপ্রিয় বন্ধু আবিদ তাকে একা ফেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে। আবিদের কথা মনে পড়তেই মনটা তার বিষিয়ে উঠল। মামাকে তখন বন্ধুর কথা জানাল। সব শুনে মামা তাকে সান্ত¦না দিলেন- ‘এই দুনিয়াতে আমরা কেউ-ই চিরস্থায়ী নই, সবাইকে একদিন না একদিন চলে যেতে হবে।’

মামার কথা শুনে দুঃখ কিছুটা কমলো। মামার সঙ্গে বাড়ি ফিরে অনেক খেলা করল জিলান।

মন অনেকটা হালকা হয়ে গেল। রাগী স্বভাবটা তার মাঝ থেকে চলে গেছে। জিলান এখন নিজেকে নিয়ে ভাবে আর বলে, কতটা বদলে গেছি আমি।

চার.

আবিদ চলে যাওয়ার আজ চার বছর হতে চলল। প্রতিদিনকার মতো আজো নদীর ধারে একাকী বসে আছে জিলান। তার মনে পড়ে, এইতো সেই বিকেল, দুই বন্ধু একসঙ্গে এখানে বসে গল্প, বড়শি দিয়ে মাছ শিকারসহ কত কিছুই না করত। আজ এসব কেবলই স্মৃতি। এ রকম হাজারো স্মৃতি এসে তাকে নাড়া দিয়ে যায়। তবুও নিজেকে পরিবর্তন করেছে এটা ভেবে তার মনটা হালকা হয়। আগে কতই না রাগী ছিল, আর এখন...?

এসব ভাবতে গিয়ে নিজের অজান্তে হেসে দেয়। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য হেলে পড়েছে।

উঠে দাঁড়ায় জিলান। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে। সূর্যের লাল রঙে ছেয়ে গেছে নদীর বুক। পানিগুলোকে মনে হচ্ছে রক্তের তরঙ্গ। নদীতীরের পাখিগুলো সব মেঘহীন আকাশে উড়ে উড়ে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবীর বুকে নেমে এলো তিমির রাত। রাতের আঁধারে চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় জিলান...।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist