ফারুক হোসেন সজীব

  ০৭ মার্চ, ২০২০

রিয়ানের অনুতাপ

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রিয়ান। খুবই আদরের। কিন্তু সমস্যা হলো, সে সরাক্ষণ বাবা-মাকে ব্যস্ত রাখে। ওটা-ওটা আবদার করে বসে। রাতবিরেতেও বাবা-মাকে ঘুম থেকে চেঁচিয়ে জাগিয়ে তোলে। মা ভয় পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে বলেন, কী হয়েছে রিয়ান সোনা? রিয়ান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, মা আইসক্রিম খাব।

এত রাতে আইসক্রিম? কিন্তু ঘরে তো আইসক্রিম নেই সোনা! তোমাকে সকালে এনে দিই? এখন অনেক রাত। ঘুমাতে যাও। রিয়ানের আবদার যেন আরো জোরদার হয়। সে জোর গলায় বলে, আমি আইসক্রিম খাব! আমার এক্ষুনি আইসক্রিম চাই! অসহায় মা রিয়ানের বাবার দিকে তাকান। রিয়ানের বাবা বুঝতে পারেন, ছেলে তাদের নাছোড়বান্দা। ওকে কোনোভাবে বুঝিয়েও কোনো কাজ হবে না। শেষমেশ বাবা উপায় না পেয়ে অত গভীর রাতেই ছেলের জন্য আইসক্রিম কিনতে বাইরে চলে যান। আশাপাশে যে দোকানগুলো খোলা ছিল, সেগুলোও এখন বন্ধ। বন্ধ তো হওয়ার কথাই। এত রাতে দোকান খুলে রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাবা তবু সামনের দিকে আরো একটু এগিয়ে গেলেন। যদি কোনো দোকান খোলা পান! কিন্তু এভাবে রাস্তায় একা একা হেঁটে যাওয়াও সত্যি বিপজ্জনক। এমনিতেই দেশের অবস্থা ভালো নয়। তবু ছেলের মুখটা মনে করে তিনি আরো সামনে এগিয়ে গেলেন। অনেক দূরে একটি দোকান দেখতে পেয়ে মনের ভেতরে একটু আশার আলো জ¦লে উঠল। তিনি দ্রুত দোকানের কাছে গিয়ে দেখলেন, একটি চায়ের দোকান। সঙ্গে রুটি-পরোটাও বানায়। জ¦লে ওঠা আশার আলো মুহূর্তেই নিভে গেল। তবু তিনি দোকানদারকে প্রশ্ন করলেন, ভাই আশপাশে কোনো আইসক্রিমের দোকান কি পাওয়া যাবে? দোকানদার রুটি বানাতে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ তিনি রিয়ানের বাবাকে দেখেই চিনতে পারলেন। কারণ অনেক দিন তিনি এই দোকানে এসে নাশতা করেছেন। দোকানদার রিয়ানের বাবাকে বললেন, এখন তো পাবেন না! তবে আপনি যখন এসেছেন, তখন আপনার তো একটু উপকার করতেই হয়! কার জন্য আইক্রিম, ছেলের জন্য? রিয়ানের বাবা আমতা আমতা করে বললেন, হ্যাঁ মানে! ছেলে ভীষণ জেদি আর একরোখা! দোকানদার হাসতে হাসতে বললেন, এই সামনেই আমার বাসা। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আমার মেয়ের জন্য কিছু আইসক্রিম কিনে রেখেছিলাম গতকাল। সেখান থেকে না হয় আপনার ছেলেকেও দু-একটি দিলাম। রিয়ানের বাবা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলেন। তিনি মাথা নিচু করে বললেন, ঠিক আছে তাই চলুন। দোকানদার বললেন, তবে যাই বলেন! এত রাতে কিন্তু আপনার বাইরে আসাটা একদমই উচিত হয়নি। দেশের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। রিয়ানের বাবা আর কথা বাড়ালেন না। দোকানদার হঠাৎ একটি গলির কাছে এসে বললেন, আপনি এখানে ওয়েট করুন। আমি বাড়ির ভেতরে যাব আর আসব। রিয়ানের বাবা ঘড়ির দিকে তাকালেন, ঘড়িতে রাত তিনটের মতো বাজে। তার মানে ফজরের আজান হতে আর এক ঘণ্টা কী দেড় ঘণ্টা বাকি। তিনি দীর্ঘশ^াস ফেললেন, মনে মনে ভাবলেন, আজ রাতে আর ঘুম হবে না। রিয়ানের বাবা দেখলেন, দোকানদার একটি ছোট্ট পলিথিন ব্যাগে আইসক্রিম নিয়ে এগিয়ে আসছেন। দোকানদার বললেন, যেই না আপনার ছেলের কথা বললাম, অমনি মেয়ে আমার ঘুম থেকে চোখ মুছতে মুছতে আপনার ছেলের জন্য আইসক্রিম বের করে দিল। ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে আমার।

আমার ছেলের কথা মানে? দোকানদার হাসতে হাসতে বললেন, আসলে আপনার ছেলে যে স্কুলে পড়ে আমার মেয়েও সেই স্কুলেই পড়ে। তাও একই ক্লাসে। মেয়ে আমার উদারপ্রকৃতির। রিয়ানের বাবা অবাক হয়ে দোকানদারের কথা শুনছিলেন। তিনি দোকানদারকে ধন্যবাদ জানালেন। আর কথা না বাড়িয়ে তিনি বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলেন। বাবা বাসায় এসে দেখলেন, রিয়ান আইসক্রিমের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। রিয়ানের মা আমতা আমতা করে বললেন, খুব চিন্তা হচ্ছিল তোমার জন্য। মনে মনে ভাবলাম, তোমার যদি কোনো বিপদ হয়? রিয়ানের বাবা বললেন, বিপদ হলে হতো তাতে আমাদের ছেলের কিছু হতো না। বাবা কথা বলতে বলতে রিয়ানের দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার আইসক্রিম। এই আইসক্রিম তোমার বন্ধু তোমাকে খেতে দিয়েছে। রিয়ান বলল, আমার বন্ধু মানে?

রিয়ানের বাবা সব খুলে বললেন। সব শুনে রিয়ান এবং মা ভীষণ অবাক।

রিয়ান বলল, তাহলে এই আইসক্রিম পুষ্পিতা তোমাকে দিয়েছে? পুষ্পিতা স্কুলের টিফিনও সবাইকেই খেতে দেয়। আর নিজে না খেয়ে থাকে। মা রিয়ানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, আর তুমি কী করো? তুমি কী পুষ্পিতার মতো হতে পারো না? আহা-রে! কী সুন্দর আর ভালো মন মেয়েটির। নিজের আইসক্রিম সব দিয়ে দিল তোমাকে। আর আমাদের ছেলে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য নিজের বাবাকে এই গভীর রাতে বাসা থেকে বের করে দিল। আসলে ওদের ছেলেমেয়েরাই মানুষের মতো মানুষ হয়।

আর আমাদের ছেলেরা আদরে আটখানা হয়ে শুধু বাবা মাকে কষ্টই দেয়। রিয়ান আইসক্রিম মুখে দিচ্ছিল হঠাৎ মায়ের কথায় তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। হঠাৎ কী যে হলো! রিয়ান বাবাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল। রিয়ান কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, বাবা মা আমি খুব সরি!

আর কখনো আমি এমনটা করব না। আমাকে ক্ষমা করে দাও তোমরা! বলেই রিয়ান অ্যাঁ-অ্যাঁ করে কান্না করতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চর্য! রিয়ানের কান্না যেন কিছুতে থামছে না! সে কান্না করেই যাচ্ছে। আর ওদিকে আইসক্রিমও গলে গলে পানি হয়ে যাচ্ছে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close