রহিমা আক্তার মৌ

  ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

দেয়াল পত্রিকাই সাহিত্যের চারা

দেয়াল পত্রিকা অনেক আগে থেকে চর্চিত শিল্প মাধ্যম। দিন দিন এর ব্যাপ্তি বা ধরন-ধারণ পাল্টেছে। শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ, মুক্তবুদ্ধি ও সাহিত্যচর্চা, ভাবের আদান-প্রদান এবং মনোবিকাশের এক অনন্য মাধ্যম এই দেয়াল পত্রিকা।

গাছ থেকে ফল পেতে হলে, ছায়া পেতে হলে যেমন গাছ লাগাতে হয়, গাছের যতœ নিতে হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে একটা বীজ থেকে চারাগাছ করে লাগাতে হয়। সাহিত্যাঙ্গনে দেয়াল পত্রিকা হলো সেই বীজ বা চারাগাছ। আমাদের দেশের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের অনেকের লেখালেখির হাতেখড়ি এই দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে। যার সুন্দর একটা উদাহরণ হলেন প্রিয়কবি সুকান্ত।

‘দেয়ালে দেয়ালে/মনের খেয়ালে/লিখে যাই কত কথা/আমি যে বেকার/পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা...।’ শিশু বয়সে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এভাবেই দেয়ালের ওপর কয়লার আঁচড় কেটে নিজের সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। আর তা দেখে কমরেড মোজাফফর আহমেদ তার হাতে খাতা আর পেনসিল তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তার মনের কথাগুলো যেন খাতায় লিখে রাখে।’ এভাবেই শুরু করেছিলেন সুকান্ত।

আমাদের দেশে দেয়াল পত্রিকা নতুন নয়, এর ইতিহাস অনেক পুরাতন। তবে কত দিনের পুরাতন, তার দিনক্ষণ কোথাও উল্লেখ করা নেই। আমাদের ইতিহাসের অনেক ঘটনা যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি অনেক কিছুর রাজসাক্ষী এই দেয়াল পত্রিকা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এসব আন্দোলনের সঙ্গে দেয়াল পত্রিকার প্রতিবাদী ভূমিকার কথা অনেকেরই জানা। যা আমরা বড়দের মুখে শুনে থাকি। এককথায় দেয়াল পত্রিকা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বিষয়। আগেকার দিনে দেয়াল পত্রিকার প্রচলন ছিল সব জায়গায়, যেমন মফস্বলে, গ্রামে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের নামকরা বা অনেক বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এমনকি ক্লাব, শিশু-কিশোর সংগঠন ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেও।

একেক স্কুলে বা প্রতিষ্ঠানে একেক নিয়মে প্রকাশ করা হয় দেয়াল পত্রিকা। মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক বা ঋতুভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা। শিশু-কিশোররাই হয় দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক বা লেখক। তবে বড়রাও ছোটদের সঙ্গে থাকতেন, ছোটদের গাইড করতেন, এখনো তাই করেন। বই আকারে বের হওয়া ম্যাগাজিনের সম্পাদকের ছাপার অংশটুকু বাদ দিয়ে যে কাজটুকু করতে হয়, দেয়াল পত্রিকার সম্পাদককেও সেসব কাজ করতে হয়। বরং দেয়াল পত্রিকার সম্পাদককে অধিক সচেতন হতে হয় বানানের ক্ষেত্রে। কারণ এটা সবার চোখের সামনে খোলা থাকে। ছাপার ক্ষেত্রে বানান ঠিক করার অনেক সুযোগ থাকলেও দেয়াল পত্রিকায় পরে বানান ঠিক করার সুযোগ থাকে না। করলেও ঘষামাজা করতে হয়, যা সবার চোখে খারাপ লাগে।

দেয়াল পত্রিকার যেমন নির্দিষ্ট তারিখ নেই, তেমনি কোনো বিষয় নেই। তবে কোনো বিশেষ দিনকে সামনে রেখে করা হলে সে বিষয়েই সবাই লিখে থাকে। ছোটরা গল্প কবিতা ও সৃজনশীল লেখা শিখে থাকে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের দেখা চারপাশের বিষয়কে তুলে ধরার সুযোগ পায়। সবার দেখার চোখ এক নয়, একই বিষয় কিন্তু ভাবনা আলাদা হয়, বলেই প্রকাশ তাদের আলাদা হয়। যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে দেয়াল পত্রিকার সাহায্যে। নিজেদের প্রবন্ধ, কবিতা, অঙ্কন এবং অন্যান্য রচনা প্রকাশ করার সুযোগ পায় দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে।

প্রাচীন যুগ থেকে মুদ্রণযন্ত্র, টাইপরাইটার এবং কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাতে লেখার এ নান্দনিক সাহিত্যপত্র বা হাতের লেখা পত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল। শুরুর ইতিহাস হারিয়ে গেলেও দেয়াল পত্রিকা তার জায়গা বজায় রেখেছে। একসময় বাংলাদেশের সব বিদ্যালয়ে ছিল দেয়াল পত্রিকার প্রচলন। মাসিক, বার্ষিক ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেয়াল পত্রিকা বের করা হতো নিয়মিত। ঐতিহাসিক দিবস উপলক্ষেও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ ছিল অনেকটা অলিখিত নিয়ম। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও প্রকাশ করত দেয়াল পত্রিকা।

দেয়াল পত্রিকাকে হারিয়ে যেতে দেবে না বলেই ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব ও প্রতিযোগিতা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় মাত্র ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে দিন দিন এই প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী বাড়ছে। নবম জাতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব ও প্রতিযোগিতা হয় ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার চত্বরে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত করতে তিন দিনের এই উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ দেয়াল পত্রিকা পরিষদ। প্রায় ১০০ স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এই উৎসব ও প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দেয়াল পত্রিকা পরিষদের সভাপতি ড. সিরাজুল ইসলাম।

দেয়াল পত্রিকা নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দেয়াল আমাদের কাছে যেমন একটি আশ্রয়স্থল ঠিক একইভাবে একটি বাধাও। স্কুল-কলেজের অনেক নিয়মকানুন আমাদের ইচ্ছার বিকাশ হতে দেয় না। এসব নিষেধাজ্ঞা আর শাসন আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে ধংস করে ফেলে। আর এ ধংসাত্মক বাধার দেয়ালকে ভাঙার মাধ্যমই হচ্ছে দেয়াল পত্রিকা। আমাদের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা দূর করে একত্রিত হওয়া, সৃষ্টিকর্মের বিকাশ এবং আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য দেয়াল পত্রিকা একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’

ভাবের আদান-প্রদান, শিল্পভাবনার বিনিময়, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মনোবিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেয়াল পত্রিকার জুড়ি নেই। খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক বা লেখকদের অনেকেই হাতেখড়ি নিয়েছেন দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় দিবস ধরে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের রীতি বেশ পুরোনো। অনেক সময় হাতের লেখার প্রয়োজনও হচ্ছে না। তার পরও দেয়াল পত্রিকা উৎসব হয়, প্রতিযোগিতা হয়, যৌথ প্রদর্শনী হয়। একসময় আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমই ছিল চিঠি লেখা, নিজের হাতে কাগজে-কলমে চিঠি লিখে তা প্রিয়জনকে পাঠানো হতো। এখন মোবাইল ইন্টারনেট আমাদের চিঠিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এখন হাতের লেখার বিপরীতে টাইপিং লেখা, খুদেবার্তা, যা পড়ে স্বাদ মিটে না। কিন্তু আমাদের আশাবাদ হাতের লেখা চিঠির মতো দেয়াল পত্রিকা হারিয়ে যাবে না, বেঁচে থাকবে।

প্রযুক্তির সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেয়াল পত্রিকায় নানা পরিবর্তনও এসেছে। একসময় তা তৈরি করা হয়েছে কাঠের তৈরি ফ্রেম আর কাগজ দিয়ে। এখন যুক্ত হচ্ছে নানা শিল্প মহিমা। বিশেষ করে পত্রিকার অবয়বকে আকর্ষণীয়, নান্দনিক এবং ঐতিহ্যময় করে তুলতে বর্তমান সময়ে কলাপাতা, পাটি, কুলা, চালনি, ডালা, চট, শোলা, শক্ত কাগজ, কাপড়, কাঁথা ব্যবহার হলেও এখন রঙিন কাগজ, রঙের ব্যবহার হাতের কাজ ও যুক্ত করা হচ্ছে দেয়াল পত্রিকার সঙ্গে।

দেয়াল পত্রিকার নির্দিষ্ট মাপ নেই, এটি কখনো হালকা বোর্ডের ওপর লেখা হয়। কখনো মোটা কাগজের ওপর লিখে তা দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। দেয়ালে সেঁটে না দিলে দেয়াল পত্রিকা হবে নাÑ এমনটি নয়। অনেক সময় সাদা মোটা কাগজে লিখে বোর্ডের ওপর সেঁটে দেওয়া হয়। দেয়াল পত্রিকা এখন আর শুধু দেয়ালে আবদ্ধ নেই। দেয়ালকে ছাপিয়ে তা চলে এসেছে দেয়ালহীন আঙিনায়, শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে, স্কুল মাঠের খোলা প্রাঙ্গণে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close