জিনিয়াস মাহমুদ

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বোন

অরিন ও অন্তরা। তারা দুই বোন। অরিন বড়। অন্তরা ছোট। তারা দুই বছরের ছোট-বড়। তবে দেখতে যেন এক রকম। একজনের মাপে জামা-জুতো কিনলে তা দুজনেই পরতে পারে। তারা দুবোন দুই বান্ধবীর মতো। একসঙ্গে খেলে। একসঙ্গে স্কুলে যায়। একসঙ্গে খায়। তাদের দুজনের মাঝে গলায়-গলায় মিল। একদিকে তাদের যেমন এমন গলায়-গলায় মিল, অন্যদিকে আবার ঝগড়াও কম হয় না। তাদের ঝগড়া হয় জামা-জুতো নিয়ে। খাওয়া-দাওয়া করতে গিয়ে। খেলাধুলা করতে গিয়ে। পড়তে গিয়ে। বসতে গিয়ে। শুইতে গিয়ে। আরো কত কী করতে গিয়ে যে তাদের ঝগড়া হয় তার যেন হিসাব নেই। ঝগড়াটা প্রথমে অন্তরাই শুরু করে। তবে তাদের ঝগড়া হলো মিষ্টি-ঝগড়া। এই আছে, এই নেই। তাদের পাড়া-প্রতিবেশী দুই বোনকে কখনোই ঝগড়া করতে দেখেনি। শুনেনি। তারা ঝগড়া করে বাড়ির ভেতরে। অন্যরা দেখবে কেমনে? আর যদি কখনো কেউ এসে দেখেই ফেলে তখন তারা দুজনেই হেসে-খেলে কথা বলে। যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে, তারা ঝগড়া করছে।

তারা দুই বোন যখন একসঙ্গে খাবার খেতে বসত, তখন অন্তরা প্রতিবারই অরিনের খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত। মা তাকে যতই দিত না কেন, তাতে যেন তার পেট ভরত না। সে অরিনের থালা থেকে একটু হলেও নেবেই নেবে। আর অরিন যখন তারটা দিতে না চাইত; তখন সে নাকিসুরে কাঁদত আর থেকে থেকে অরিনের গায়ে চিমটি কাটত। পরে অরিনও চিমটি কাটত অন্তরাকে। আবার অন্তরা প্রায়ই তার জামা-জুতো রেখে অরিনেরটা নিয়ে সে পরত। অরিন তারটা দিতে না চাইলেই শুরু হতো অন্তরার কান্নাকাটি আর দুজনের চিমটাচিমটি। এভাবেই শুরু হত দুই বোনের দুষ্টু-মিষ্টি ঝগড়া। আর এভাবেই কাটত তাদের দিন-মাস-বছর।

একদিন দুপুরবেলা। খুব গরম পড়ে। মা বেলের শরবত বানান। তখন তারা দুই বোন স্কুলে ছিল। কিছুক্ষণ পরেই তারা চলে আসে। মা তাদের দুজনকে দুই গ্লাস শরবত দেন। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলতে চলতে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় চলে যায়। দুজনের একজনও শরবত খায় না। অরিন খেতে চাইলেও অন্তরা তাকে খেয়ে দেয় না। অন্তরার ধারণা, নিশ্চয় অরিনের গ্লাসের শরবতটা স্বাদ বেশি! তাই সে অরিনেরটা খেতে চাইল। কিন্তু অরিন তারটা দিতে চায় না। এ নিয়ে তাদের মাঝে শুরু হয় কথা কাটাকাটি। অবশেষে সে শরবত আর কেউই খেতে পারেনি। হঠাৎই কোত্থেকে একটা বিড়াল এসে দুজনের শরবতই ফেলে দিয়ে দৌড় দেয়। এতে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে। অরিন বলে, তোর জন্য শরবত খেতে পারিনি। অন্তরা বলে, তোর জন্য শরবত খেতে পারিনি। এভাবেই চলে যায় কিছু সময়। তারপর অন্তরা অরিনকে চিমটি মেরেই ভোঁদৌড়...। পিছু পিছু ছুটে অরিনও।

তার কিছুদিন পর। হঠাৎ করেই একদিন অরিনের গায়ে প্রচ- জ্বর আসে। জ্বরে সে কাঁপতে থাকে। বাবা ডাক্তার ডাকেন। ডাক্তার এসে জ্বর মাপেন। তারপর ওষুধ দিয়ে চলে যান। বাবা দোকান থেকে কেক, কলা, রুটি আনেন। অরিনকে এগুলো খেয়ে পরে ওষুধ খেতে বলেন। সে খায় না। এসব তার ভালো লাগে না। ভাতও খায় না। ওষুধ খায় খালি পেটে। এভাবে কদিন চলে যায়। জ্বর কমে না। অন্তরা সারাক্ষণ অরিনের পাশেই বসে থাকে। গামছা ভিজিয়ে অরিনের শরীর মুছে দেয়। মাথায় পানি ঢালে। হাত-পা টিপে দেয়। অরিনের মুখে হাসি নেই বলে হাসে না অন্তরাও। মনমরা হয়ে বসে থাকে। কখনো দুহাত তুলে বোনের জন্য দোয়া করে; আপুটি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। অরিন জ্বরে কখনোবা আবোল-তাবোল কথা বলে ওঠে। কদিন না খেয়ে মুখটাও কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। শুধু কি অরিনেরই এমন দশা? তার সঙ্গে অন্তরারও। সেও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তার অসুখ-টসুখ কিছু নেই। অরিন খায় না বলে সেও খায় না। অরিন যখন জ্বরে আর শরীর ব্যথায় হঠাৎই চিৎকার করে উঠে তখন কেঁদে উঠে অন্তরাও। দুই মেয়ের এমন অবস্থা দেখে মায়ের দুচোখ জলে ভরে যায়। বাবারও যেন চিন্তার শেষ নেই।

বিকালবেলা। মা অরিনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, দ্যাখ মা, তুই খাচ্ছিস না বলে অন্তরাও কিছু খাচ্ছে না। আর তোরা এমন না খেয়ে থাকলে আমরা কী করে খাই বল? জ্বর এলে কারোরই কোনো খাবারে রুচি থাকে না। তাই বলে কী, না খেলে চলবে? এতে তো সমস্যা আরো বাড়বে। তোর বাবা আর আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। অন্তরার কথা ভেবে হলেও তোকে খেতে হবে, মা। না হলে সেও যে এভাবে না খেয়ে থাকতে থাকতে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়বে।

মায়ের কথা শুনে জল-টলমল-করা দুচোখে অরিন অন্তরার দিকে তাকায়। সে দেখে অন্তরার দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অরিন অবাক হয়ে ভাবে, বরাবর যে অন্তরা আমার খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত, সে অন্তরা আজ আমি খাচ্ছি না বলে সেও খাচ্ছে না। আমি কাঁদছি দেখে সেও কাঁদছে। আমার কষ্টে সেও কষ্ট পাচ্ছে! ভাবতে ভাবতে চোখের জল মুছে সে। পরে অন্তরার সহযোগিতায় শোয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় অন্তরাকে বলে, কিরে, তুই কিছু খাচ্ছিস না যে? জ্বর তো আমার। তুই তো সুস্থ আছিস। আমার মতো না খেয়ে থাকলে তুই তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। আগে না সব সময় আমার খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করতি। জোর করে আমারটা খেয়ে ফেলতি। এখন আমি খাচ্ছি না বলে তুই খাচ্ছিস না কেন? কদিন ধরে টেবিলে কত খাবার পড়ে আছে। তা তুই ছুঁয়েও দেখছিস না। গতকাল মামা তোর আর আমার জন্য জামা কিনে পাঠিয়েছে। তাও তুই প্যাকেট খুলে দেখছিসনি। এর আগে মামা আমাদের জন্য যখনই কোনো জামা বা অন্যকিছু পাঠিয়েছে, তুই তোর পছন্দমতো না নেওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে প্যাকেটটাও ছুঁতে দিতিস না। আর এখন তুই ...!

অরিনের কথা শেষ হতে না হতেই অন্তরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে অরিনকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে, আপু! আপুরে! তোর সঙ্গে আমি যতই কাড়াকাড়ি করি, যতই মারামারি করি, তোকে ছাড়া আমি অন্ধরে আপু। দুচোখে শুধু অন্ধকার দেখি। তোকে ছাড়া আমি খেতে পারি না। তোকে ছাড়া আমি পরতে পারি না। চলতে পারি না। বলতে পারি না। হাসতে পারি না। কিচ্ছু করতে পারি না আমি তোকে ছাড়া। তোর কিছু হলে আমি বাঁচব নারে আপু। এই বলে অন্তরা আর কোনো কথা বলে না। সে অরিনকে জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। অন্তরার কান্না দেখে অরিনের দুচোখে আবারও জল চিকচিক করে ওঠে। সে অন্তরার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, কাঁদিস না বোন। আমার কিচ্ছু হবে না। দেখিস, কদিনের মধ্যেই আমি ঠিক সুস্থ হয়ে উঠব। আবারও আমরা দুই বোন হাসি-আনন্দে মেতে উঠব।

এবার পাশেই বসে থাকা তাদের মা শায়লা বেগম আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছেন। পরে অরিন আর অন্তরার চোখের জলও মুছে দেন। তারপর টেবিল থেকে একটা কেক নিয়ে অরিনের দিকে বাড়িয়ে দেন। অরিন কেকটা হাতে নিয়ে অন্তরার মুখে একটু তুলে দেয়। অন্তরাও কেক তুলে দেয় অরিনের মুখে। যা দেখে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। তিনি একবার অরিন আরেকবার অন্তরার মাথায় হাত বোলান আর বলেন, খা, মা। খা। আমি দোয়া করি, তোদের এক বোনের প্রতি আরেক বোনের এই ভালোবাসা যেন আজীবন থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close