আবদুস সালাম

  ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

পাখির ডিম

অনিকের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মুজিবনগর উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে তার দাদার বাড়ি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদী। দাদার বাড়ির নিকটেই ফসলের মাঠ। গ্রামটি দেখতে খুব সুন্দর। প্রতি বছরের মতো এবারও অনিক ছুটির কটা দিন দাদার বাড়ি কাটাতে চায়। গ্রামে তার সমবয়সের বেশ কয়েকজন চাচাতো ভাইবোন রয়েছে। এ ছাড়াও গ্রামে তার বেশকিছু বন্ধুু রয়েছে। গ্রামে তাদের সঙ্গে থাকলে বেশ মজা করে সময় কাটানো যায়। এ সময় পড়াশোনার কোনো চিন্তা থাকে না। আর রাতে ঘুমানোর সময় দাদা সুন্দর সুন্দর রূপকথার গল্প বলেন। দাদার গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে। তা ছাড়া দাদি শীতের সময় নানান রকমের পিঠাপুলি তৈরি করেন। সেসব পিঠাপুলি খেতেও তার মনটা আনচান করে। তাই অনিক দেরি না করে দাদার বাড়ি বেড়াতে গেল।

অনেক দিন পর অনিককে দেখে তার চাচাতো ভাইবোনরা খুব খুশি হলো। তারা অনিককে নিয়ে কীভাবে সময় কাটাবে, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে, তার একটা পরিকল্পনাও করে ফেলল। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও তারা বেড়াতে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে তো খেলাধুলা চলছেই। দাদার বাড়ির পেছনের দিকে একটি বড় আমবাগান আছে। এখানেই তারা বেশির ভাগ সময় খেলাধুলা করে। শীতকালে ভৈরব নদীতে পানি কম থাকে। এ সময় নদীতে মাছ ধরতেও অনিকের খুব ভালো লাগে। তাই সময় পেলেই অনিক তার চাচাতো ভাইবোন ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নদীতে যাচ্ছে মাছ ধরতে। বিকালবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে নদীর পাড়ে হাঁটতে তার খুব ভালো লাগে। সারা দিন খেলাধুলা আর ঘুরে বেড়িয়ে অনিকের সময়টা বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসে। রাতের খাওয়া-দাওয়াও তাড়াতাড়ি করে ফেলে। তারপর রাতে ঘুমানোর সময় দাদার কাছে রূপকথার গল্প শোনে। দাদা প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর রূপকথার গল্প বলেন। গল্প শুনতে শুনতে তার ঘুম এসে যায়।

সকালবেলায় অনিক ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি ওঠে পড়ে। উঠানে খড়, নাড়া এবং কাঠের টুকরা জ্বালিয়ে অনিকের আগুন পোহাতে খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে এভাবে আগুন পোহায়। সকালের নাশতা সেরে যথারীতি সে খেলাধুলায় মেতে ওঠে। আমবাগানের পেছনে একটি বড় সেগুনগাছ ছিল। আজ সকালে অনিক তার প্রিয় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সেই সেগুনগাছের নিচে খেলাধুলা করছিল। বন্ধুদের মধ্যে একজনের নাম ছিল বাবলু। সে আজ অনিকের সঙ্গে অনেক গল্প করেছে। গল্পের সময় অনিককে বলেছে যে, এই সেগুনগাছে বেশ কয়েকটা শালিক পাখির বাসা আছে। সেসব বাসাতে সুন্দর সুন্দর পাখির ডিমও রয়েছে। শালিক পাখির ডিম হালকা আকাশি রঙের। দেখতে খুব সুন্দর। গাছের গোড়াটা বড় হওয়ার কারণে কেউ উঠতে পারে না। খেলা শেষে অনিক দুপুরের আগেই বাড়িতে ফিরে আসে।

অনিক খুব সাহসী। সে কখনো ভূত-পেতনির ভয় করে না। তার খুব ইচ্ছা হলো যেভাবেই হোক সে পাখির বাসা হতে ডিমগুল পাড়বে। এর জন্য সে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু পাখির ডিম পাড়ার বিষয়টি সে আপাতত গোপন রাখল। তার দাদার বাড়িতে একটি বড় মই ছিল। অনিক চিন্তা করল গাছে ওঠার জন্য এই মইটি তার বেশ কাজে লাগবে। দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন সবাই বিশ্রাম নিতে এবং অন্যান্য কাজেও ব্যস্ত ছিল; ঠিক সেসময় অনিক সবার অজান্তে মইটি কাঁধে নিয়ে সেই সেগুনগাছের উদ্দেশে রওনা দিল। সে গাছের নিকটে পৌঁছাল এবং মই দিয়ে গাছে উঠল। এ সময় গাছের নিচে কয়েকটি কুকুর খেলা করছিল। অনিক গাছে উঠে পাখির বাসা হতে কয়েকটি ডিম সংগ্রহ করল। ডিমগুল সংগ্রহ করতে পেরে সে ভীষণ খুশি হলো। সে যখন গাছ থেকে নামার মনস্থ করল, ঠিক তখনকুকুরগুলো দৌড়াদৌড়ি করছিল। একপর্যায়ে একটি কুকুরের ধাক্কায় মইটি মাটিতে পড়ে গেল।

মইটি মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফলে অনিক আর গাছ থেকে নামতে পারল না। তার পক্ষে উঁচু গাছ থেকে লাফ দেওয়াও সম্ভব নয়। লাফ দিলে নিশ্চিত তার হাত-পা ভেঙে যাবে। শুধু তাই নয়, তার মৃত্যুও হতে পারে। তাই সে উপায় না পেয়ে গাছের ওপর বসে থাকল। আর অপেক্ষা করল কাউকে গাছের আশপাশে দেখা যায় কি না। বেশ কিছুক্ষণ সে অপেক্ষা করল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে যাচ্ছে। সে কয়েকবার গাছের ওপর থেকে চিৎকার করেছে, কিন্তু কেউই তার চিৎকার শুনতে পায়নি। তার মনেও একটু একটু ভয় করছে। সে অবশ্য মনে মনে ভাবল, আমাকে না পেয়ে কেউ না কেউ বাগানের ভেতর খুঁজতে আসবে। আর শেষ পর্যন্ত যদি কেউ না আসে, তাহলে সে গাছ থেকে লাফ দেবে।

এদিকে বেশ কিছুক্ষণ অনিককে না দেখে তার দাদা, চাচা এবং চাচাতো ভাইবোনরা বিকালবেলা থেকেই খোঁজাখুঁজি শুরু করল। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। অনিককে না পাওয়াতে সবার মনে ভয় হলো। ইতোমধ্যে সন্ধ্যার আজান পড়ে গেল। অনিকের কী হলো, সে কোথায় গেল, কোথায় যেতে পারে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। কারোর মাথায় কিছু আসছিল না। এদিকে অনিককে খুঁজে না পাওয়ার বিষয়টি দ্রুত সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের বৃদ্ধ রহিম চাচার কানেও কথাটি পৌঁছিয়ে গেল। রহিম চাচা তো আজই দুপুরের দিকে বাগানের পাশ দিয়ে আসার সময় অনিককে একটি মই কাঁধে নিয়ে বাগানের ভেতরে যেতে দেখেছে। তাই তিনি ভাবলেন, এই খবরটি অনিকের দাদার বাড়িতে দেওয়া দরকার। এ খবরটি দেওয়ার জন্য তিনি অনিকের দাদার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। তারপর সকলের সামনে রহিম চাচা এই খবরটি দিলেন। রহিম চাচার কথা শুনে প্রথমেই বাড়ির লোকজনরা মইটি খোঁজা শুরু করল। কিন্তু কোথাও মইটি পাওয়া গেল না। তা হলে রহিম চাচা যা বলেছেন তা ঠিকই বলেছেন। নিশ্চয় সে মই নিয়ে বাগানের ভেতরে ঢুকেছে। আত্মীয়স্বজনরা অনিককে খুঁজতে দ্রুত বাগানের ভেতরে টর্চলাইট নিয়ে ঢুকে পড়ল। বাগানের চারিপাশে তাকে খোঁজা হলো। কোথাও তাকে পাওয়া গেল না।

এদিকে অনিক টের পেয়েছে যে, বাগানে কিছু লোক প্রবেশ করেছে তাকে খুঁজতে। তাদের উদ্দেশ্য করে সে খুব জোরে জোরে চিৎকার করল। আমি এদিকে... আমি এদিকে...। এমন সময় তার চিৎকারের শব্দ অনেকেই শুনতে পেল। শব্দটি আসছিল বাগানের শেষ প্রান্ত থেকে। তারপর সবাই ছুটে গেল বাগানের শেষ প্রান্তে। দূর থেকে দেখা গেল যে, সেগুনগাছের নিচে পড়ে আছে সেই বড় মইটি। তারা সেখানে পৌঁছে গেল। গাছে টর্চলাইট মেরে দেখল যে, অনিক গাছের ডালের ওপর বসে আছে। তারা বুঝতে পারল মইটি পড়ে যাওয়ার কারণে সে গাছ থেকে নামতে পারেনি। অবশেষে অনিক মইয়ের সাহায্যে নিচে নেমে এলো। অনিককে পেয়ে তারা সবাই খুশি হলো। তারপর অনিক সবার সামনে পাখির ডিম পাড়ার বিষয়টি বর্ণনা করল। আর সে প্রতিজ্ঞা করল যে, ভবিষ্যতে আর কখনো এ রকম কাজ করবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close