সুমন আহমেদ

  ০৮ জুন, ২০১৯

ঈদের জামা

ঈদ মানেই তো আনন্দ উৎসব আর অন্যরকম অনুভূতি। নতুন নতুন জামা-কাপড় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সারা দিন আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকা সীমাহীন সুখের মুহূর্ত। কিন্তু আমার বেলায় ছিল তা ভিন্ন। শৈশবে গত হয়ে যাওয়া ঈদগুলো, আনন্দ-উল্লাস তো দূরের কথা; অভাব-অনটন ছাড়া আর কিছুই জোটেনি ভাগ্যে। নুন আনতে পান্তা ফোরানোর ছিল আমাদের সংসার। আমাদের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বাবা। বাবা এক দিন কাজে না গেলে পরদিন আমাদের উপোস থাকতে হতো। কোনো দিন হয়তো দুবেলা খাবার জুটত, কোনো দিন হয়তো জুটত না। অভাবের আগুনে পুড়ে পুড়ে হয়েছি দগ্ধ।

বাবার চোখে দেখেছি অভাব নামের যন্ত্রণার সীমাহীন আকাশছোঁয়া পাহাড়। দেখেছি শাড়ির আঁচলে মুখ লুকানো মায়ের ভেজা চোখ আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করা একমাত্র আদরের ছোট্ট বোনটা হাহাকার। প্রতিবারের মতো এবারও একই আবদার বাবার কাছেÑ এবার লাল পাঞ্জাবি আর প্যান্ট কিনে দিতেই হবে। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন... ঠিক আছে বাবা, এবার আর প্রতিবারের মতো পুরোনো জামায় ঈদ করতে হবে না। তোকে এবার নতুন জামা কিনে দেবই দেব। বাবার এক কথায় যেন খুশির জোয়ারে ভাসছি আমি, সুখ নামের সুখপাখিটা যেন বারবার বেলা-অবেলায় কড়া নাড়ছে আমার আঙিনায়; মুহূর্তেই যেন পৃথিবীর সব সুখ এসে পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সব বন্ধুকে জানিয়ে দিলাম এবার ঈদে আমিও নতুন জামা পরব। ঈদের কিছুদিন আগে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুখ নামের স্বপ্নটা বোধহয় এবারও পূর্ণ হবে না। বাবার গায়ে প্রচন্ড জ্বর, কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। ওষুধ কেনারও পয়সা নেই। দুই দিন ধরে শুধু পানি খেয়ে মা রোজা রাখছেন; ছোট্ট বোনটা ক্ষুধার জ্বালায়

ছটফট করছে। মার গাল বেয়ে দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে তো পড়ছেই। পাড়া-পড়শিদের কাছে হাত পাততে পাততে এখন আর তাদের সামনে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। ছোট্ট বোনটা কান্না দেখে মা এবার হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। মায়ের কান্না দেখে আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। কাউকে না বলে বাবার রিকশাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা রিকশা চালিয়ে মাথার গাম পায়ে ফেলে আমাদের সংসার চালাতেন। সারা দিন রিকশা চালিয়ে বাবার ওষুধ আর চাল-ডাল নিয়ে রাতে বাড়িতে ফিরলাম। সারা দিন আমাকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে আর কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট বোনটাকে বুকে আগলে ধরে মা ঘুমিয়ে পড়েন সঙ্গে বাবাও...। ঘরে ঢুকতেই ডাক শুরু করলাম কোথায় গেলে গো মা? আমার ডাক শুনে বাবা-মা দুজনই ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। আমার হাতে বাজার সদাই দেখে বললেন, কোথায় পেলি এসব আর সারা দিন কোথায় ছিলি? বাবা-মা দুজনকেই সবকিছু খুলে বললাম। সব কথা শোনার পর বাবা আমাকে বুকে আগলে ধরে কান্না শুরু করলেন সঙ্গে মাও...। সেই সঙ্গে আমিও...।

বাবা-মা দুজনই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই এক দিন অনেক বড় হবি বাবা অনেক বড়। বাবার কথাটা মিথ্যে হয়ে যায়নি এখন আমি অনেক বড়। কিন্তু দুঃখ একটাই সুসময়ে আজ বাবা নেই পাশে। অভাব-অনটনকে অবসর দিয়ে, মায়ার পৃথিবীর ছেড়ে বাবা চলে গেলেন অচেনা ঠিকানায়Ñ না ফেরার দেশে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ঈদের দিন সকালে রিকশা নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। দুই ভাইবোনের জন্য নতুন জামা কিনে বাবা বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে ট্রাক এসে রিকশাসহ বাবাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। সেই ঈদে বাবা আমাকে নতুন জামা কিনে দেওয়া কথা রেখেছিলেন ঠিকই, তবে সেই জামায় আজও অবধি লেগে আছে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া বাবার শরীরের রক্তের দাগ। বাবা চলে যাওয়ার পর কত ঈদ গত হয়ে গেল আজও অবধি গায়ে জড়াইনি ঈদের নতুন জামা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close