ফারুক হোসেন সজীব

  ০৯ মার্চ, ২০১৯

মার্চের জেনোসাইড

মার্চ মাস এলেই কেমন অদ্ভুত থমথমে ভাব বিরাজ করে তাই না দিবা? দিবা দাদুর হাত ধরে হাঁটছে আর বারবার দাদুর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ছোট্ট দিবা কিচ্ছুটি বুঝতে পারছে না দাদুর কথাগুলো! প্রতিদিন ভোরে দিবা দাদুর সঙ্গে হাঁটতে বের হয়। দাদুর সঙ্গে হাঁটতে দিবার খুব ভালো লাগে। দাদু হাঁটতে হাঁটতে এমন মজার মজার গল্প বলেন যে, দিবা সত্যি অবাক না হয়ে পারে না! দিবা খেয়াল করেছে ইদানীং দাদু দেশ এবং ভাষা নিয়ে বেশি বেশি গল্প বলছেন। কিন্তু‘ গল্প বলতে বলতে দাদু কোথায় যেন হারিয়ে যান। দিবা, দাদুর গল্পগুলো শুনছে কী শুনছে না, দাদু যেন সেদিকে কোনো খেয়াল-ই করেন না! তাই মাঝে মাঝে দিবা দাদুর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, অন্য আরেকটা গল্প বলো দাদু! এখনো তাই হচ্ছে দাদু হঠাৎ উদাস হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন! দিবা তাই দাদুকে একটু ঝাঁকুনি দিল! দাদু, দিবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। দাদু হাসলে দিবার কী যে ভালো লাগে! আর দাদুর মন খারাপ থাকলে দিবারও কেমন মন খারাপ হয়ে যায়! দিবা খেয়াল করেছে, দাদু এখন তাকে নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। তারপর সামনে আরেকটি রাস্তা পাওয়া যাবে, রাস্তাটি পার হলেই তবেই তাদের বাড়ি। দাদু দিবাকে বললেন, দিবা হেঁটে-হেঁটে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এসো বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক! দিবা দেখল, দাদু শহীদ মিনারের সিঁড়িতে জুতো খুলে বসে পড়লেন, আর বললেন, গেল একুশে ফেব্রুয়ারির কথা তোমার মনে আছে দিবা?

দিবা অবাক হয়ে বলল, কেন মনে থাকবে না? এই তো ক’দিন আগেই তো একুশে ফেব্রুয়ারি চলে গেল! দাদু বললেন, এখন মার্চ মাস আর এই মার্চ মাস আরো ভয়াবহ দিবা! শুনে দিবা কেমন অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকাল! জিজ্ঞেস করল, কেন! ভয়াবহ কেন?

দাদু বললেন, বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যা! ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিনের এই গণহত্যার স্বরূপ ছিল আরো ভয়ংকর! পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি আর রাজাকার বাহিনীরা বাঙালিদের খুন করেছিল! ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম, হত্যা, শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিল! এসব হামলার সহযোগী ছিল বাঙালি ও অবাঙালি সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা! পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম বাঙালি নিধন অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে! এই অভিযানের মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী মুসলিম লীগকেই কেবল উৎখাতের পথ-ই বেছে নেয়নি, একই সঙ্গে বাঙালি সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্রজনতাকে নিধন করার পরিকল্পনাও তারা করেছিল! নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এই সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের ফলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়! ফলে ভারতের মাটিতে প্রায় এক কোটি মানুষের দেশান্তরিত হওয়ার মর্মান্তিক অধ্যায়ও ঘটে!

কিন্তু‘ জানো দিবা! ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ঐতিহাসিক সত্যকেই তারা বিকৃত আর আড়াল করেছে! পাকিস্তানের স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও তারা তাদের মতো মনগড়া ইতিহাস যোগ করেছে! ফলে তাদের নতুন প্রজন্মকেও করে ফেলেছে ইতিহাসশূন্য জাতি!

এতক্ষণ কথাগুলো বলে দাদু কেমন হাঁপিয়ে উঠলেন, দিবার হাতে পানির বোতল ছিল, দিবা দাদুকে পানির বোতলটি এগিয়ে দিল! দিবা দেখল, দাদুর মুখটি কেমন শুকিয়ে গেছে! দিবা পানির বোতলটি এগিয়ে দিচ্ছে দেখে দাদু কেমন মিষ্টি করে হাসলেন!

তারপর দাদু দিবাকে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন! হাঁটতে হাঁটতে দাদু বললেন, বুঝেছ দিবা, কেবল পাঠ্যবই থেকেই আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস জানলে হবে না! সবার ঘরে-ঘরে যেতে হবে! বাঙালিদের প্রতিটি ঘরেই রয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস! ওগুলোকে খুঁজতে হবে, জানতে হবে, কতটা ভয়াবহ ‘জেনেসাইড’ তারা করেছিল!

দিবার বলল, দাদু জেনোসাইড কী?

দাদু, দিবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জেনোসাইড’ ইংরেজি শব্দ যার অর্থ ‘গণহত্যা’ অর্থাৎ বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা ধর্ম, বর্ণ ও বিশ^াসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকান্ড, আক্রমণ ও পীড়ন! যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়! জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ও এই সংজ্ঞার স্বীকৃত আছে! সে কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের ¯ানীয় দোসরদের হাতে যে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ঘটে, তা সব অর্থেই গণহত্যা বা জেনোসাইড! এখন বুঝতে পেরেছ?

দিবা অবাক হয়ে দাদুর মুখে দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল! দিবা দাদুকে এখন বারবার অবাক চোখে দেখছে! আর মনে মনে ভাবছে, দাদু সত্যি অনেক ভালো মানুষ! না হলে দিবা এত কিছু কোনদিন জানতেই পারত না! কে বলত তাকে বাংলাদেশের ইতিহাস? বাংলাদেশের ইতিহাস তো আজকাল কেউ তাকে বলে না! বলতে চায়ও না!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close