রুমান হাফিজ

  ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিজয়ের গল্প

আজ সবুজের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবে। এ কথা ভাবতেই তার কত না খুশি লাগছে। এ খুশির একটা কারণও আছে। মা বলেছিলেন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে নানুবাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। পড়ালেখার চাপ, পাশাপাশি বাবার কর্মব্যস্ততার কারণে কতদিন নানুবাড়িতে যাওয়া হয় না। সবুজের বাবা ফয়াজ সাহেব এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান। আর ধন-সম্পদের ব্যাপকতা তো আছেই। নানা কাজের মধ্যে তাকে সদা ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে সবুজের কোথাও তেমন বেড়ানোর সুযোগ হয় না। ফয়াজ সাহেবের সততা ও কর্মনিষ্ঠার কারণে এলাকার সবার কাছে একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তার কাছে ধনী-গরিব সবাই সমান। সব সময় তিনি চেষ্টা করেন সমাজের জন্য ভালো কিছু করার। গরিব এবং অসহায়দের তিনি সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি নিজের থেকে সহযোগিতার চেষ্টা করেন। তার এসব ভালো কাজ যা সর্বমহলে প্রশংসিত হতে থাকে।

পরীক্ষা শেষ করেই সবুজ বাড়ি ফিরে। মাকে নানু বাড়িতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। মা বললেন, হ্যাঁ বাবা তোমাকে আজই নিয়ে যাব। তবে শর্ত হলো দুদিনের বেশি থাকা যাবে না। সবুজ এতে সহমত পোষণ করে। কারণ সে মনে মনে ভাবে যে কোনোভাবে যেতে পারলেই হলো। নানুবাড়িতে মামাতো ভাই ফাহিম তার খেলার সাথি। সবুজ নানু বাড়িতে বেড়াতে আসলেই ফাহিমের সাথে তাদের মাঠে খেলতে যায়। একবার এলাকার একটি প্রতিযোগিতায় ফাহিমদের দল প্রথম হয়। সেই খেলায় সবুজও ফাহিমদের দলে ছিল। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সবুজ দুপুরের খাবার সেরে নিল। মা বললেন তাড়াতাড়ি রেডি হতে। সবুজ হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে তার ব্যাগে কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। নানুবাড়িতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। রাতের খাবারে নানু, মামা, মামানি, ফাহিমসহ সবাই একসাথে বসলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবুজ তার নানুর কাছে ঘুমাতে যায়। সবুজের নানু অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প বলতে পারেন। বয়সের দিক থেকে তিনি মনে হয় এলাকার সবার চাইতে বড় হবেন। তার সমবয়সী কেউ নেই বললেই চলে। তবে এখনো তিনি অনেকটা ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন।

পরদিন রাতে সবুজ তার নানুর কাছে বায়না ধরে। তাকে গল্প শোনাতেই হবে। নাতির আবদার কী আর করা। এ বয়সে টানা কথা বলতে খানিকটা সমস্যা হলেও তিনি শুরু করলেন। সেই গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কার একটি ঘটনা। সবুজের সাথে তখন ফাহিমও বসা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করেছিল। দল মত নির্বিশেষে দেশের সবাই সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সেই যুদ্ধে আমাদের এক সাগর রক্ত দিতে হয়েছিল। আমাদের এই জন্মভূমি বাংলাদেশ তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। এই লাল-সবুজের পতাকায় মিশে আছে তাদের স্মৃতি। আজ আমরা দেশে মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছি তাদের আত্মদানের কারণে। তাদের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই আত্মদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তোমাদের নানাও ছিলেন। এ কথা শুনে সবুজ ও ফাহিমের মন আনন্দে ভরে উঠল। তারা দুজন আরো মনোযোগী হলো। নানু বলতে লাগলেন, সেই সময়ে একবার আমি ঘরের মধ্যে রান্নাবান্না করছিলাম হঠাৎ করে গুলির শব্দ শুনতে পাই। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হলাম। বাড়ির চতুর্দিকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ঘেরাও করে রেখেছে। তারা আমাকে দেখতে পেয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, তোর স্বামী কোথায়? আমি বললাম উনি বাড়িতে নেই, কাজের জন্য বেরিয়ে গেছেন। এ কথা বলার সাথে সাথে তারা আমার মাথার কাছে বন্দুকের নল তাক করে, বলে তোর স্বামী কোথায় আছে সঠিক করে বল না হয় এখনই গুলি করব। আমি তখন ভয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি। ফলে আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখতে পাই, আমার মাথার উপরে পানি ঢালা হচ্ছে এবং আরেকজন পাশে বসে বাতাস দিচ্ছে। আরো অনেকজন আশপাশে দাঁড়ানো, বসা। তখনো আমি বুঝতে পারিনি, আমার কি হয়েছিল। এদিকে তারা আমার ঘরে প্রবেশ করে বিভিন্ন জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলে। সারাদিন সারারাত আতংকের মধ্যে থাকি। কখন যেন আবার এসে আক্রমণ শুরু করে দেয়। এদিকে তোমাদের নানা যুদ্ধের প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনীর সাথে ট্রেনিং দিতে চলে যান। তার সাথে এলাকার আরো কয়েকজন ছিল। অনেকদিন পর ট্রেনিং শেষ করে একদিন ফজরের সময় তিনি বাড়িতে আসলেন। তখন তার সমস্ত শরীর ভেজা। তিনি ভীষণভাবে কাঁপতেছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই অবস্থা কেনো? তিনি বললেন, আমরা ট্রেনিং থেকে আসতেছি এ খবর পাক বাহিনী পেয়ে যায়। তারা আমাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে। জীবন বাঁচাতে আমরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তাদের কাছ থেকে পালিয়ে আসি। আমি কাপড় বের করে দিলাম। তিনি সেগুলো বদলে নিলেন। সেই দিনই পাক বাহিনী আমাদের এলাকায় আক্রমণে আসবে এই খবর জানতে পেরে তার অন্য সাথীদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। সেই যে চলে গেলেন আর কখনো বাড়িতে ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীন হলে পরে জানতে পারি তিনি পাক বাহিনীর হাতে যুদ্ধের মধ্যে নিহত হয়েছেন। কত কষ্ট না হয়েছিল সে দিন। সেই সময়ে কত কষ্ট সহ্য করে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিনযাপন করেছি। আজ সেই দিনগুলোর কথা যখন চোখের সামনে ভাসে তখন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। নানুর সাথে সবুজ ও ফাহিমের চোখে অশ্রুকণা টলমল করছে। এমন সময় ফাহিমের মা ডাক দিলেন রাতের খাবারের জন্য। সবুজ ও ফাহিম হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে যায়। এ সময় ফাহিমের বাবা ঘরে আসেন। ফাহিমের বাবা ফারুক সাহেব সরকারি চাকরি করেন। সে জন্য তার বাড়িতে তেমন থাকা হয়না। কাল সরকারি ছুটি ফলে তিনি রাতেই বাড়িতে চলে আসলেন। খেতে বসে তিনি সবুজকে তার পড়ালেখার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফারুক সাহেব সবুজ ও ফাহিমকে তার রুমে ডাকলেন। বললেন, আমি কাল তোমাদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে যাব। তোমরা রেডি থাকবে। হ্যাঁ মামা নিশ্চয়ই! উত্তর দিল সবুজ। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা শুনে তারা দুজন ভীষণ খুশি হয়। সকালবেলা সবুজ ও ফাহিম কাপড়-চোপড় পরে তৈরি হয়। হালকা নাস্তা সেরে ফারুক সাহেব তাদের নিয়ে চললেন অনুষ্ঠানের দিকে। কিছুপথ যাওয়ার পর তাদের কানে ভেসে উঠল বিজয়ের গান। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল/জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো/মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবা বলে যুদ্ধ করি/একটি

বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহঙ্কার।’ প্রভৃতি গান শুনতে শুনতে তারা

অনুষ্ঠানে গিয়ে পৌঁছাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close