সারমিন ইসলাম রত্না

  ২০ অক্টোবর, ২০১৮

প্রশ্নকন্যা

আব্বু আমাকে খুব ভালোবাসেন, কিন্তু তিনি আমাকে পটোল বলে ডাকেন। একদিন প্রশ্ন করলাম, তুমি আমাকে পটোল বলে ডাকো কেন? আব্বু বললেন তুমি দেখতে ঠিক পটোলের মতো। আমি রান্নাঘর থেকে একটি পটোল নিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে মেলানো শুরু করলাম, সত্যিই তো! আমি দেখতে ঠিক পটোলের মতো। কী অবাক কা-! মানুষের সঙ্গে পটোলের এত মিল! আচ্ছা আব্বুকে দেখতে কিসের মতো দেখায়? আব্বু বেশ লম্বা, খুব যে মোটাসোটা তা-ও না। হুম পেয়েছি আব্বুকে দেখতে ঠিক ঝিঙের মতো দেখায়! সেই থেকে আমি আব্বুকে ঝিঙে আব্বু বলে ডাকি।

পৃথিবীর সবকিছু নিয়েই আমার অনেক কৌতূহল, তাই আমি সবার কাছে অনেক কিছু জানতে চাই, বেশি বেশি প্রশ্ন করি। আব্বু-আম্মু ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। আমিও দেখছিলাম। আমি আব্বুকে প্রশ্ন করলাম, আব্বু টিভি চলে কেন? আব্বু বললেন, টিভি চলার জিনিস তাই চলে। হুম তা তো বুঝলাম, কিন্তু টিভির ভেতরে মানুষগুলো এত ছোট ছোট হয়ে কীভাবে ঢুকল? আব্বু বললেন, মেশিনের মাধ্যমে। ওরাও কি আমাদের মতো খাওয়া-দাওয়া করে? আব্বু বললেন, অবশ্যই করে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, বলো কী! সত্যি? হ্যাঁ সত্যি। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ফ্যান ঘুরে কেন? আব্বু বললেন, ফ্যান ঘোরার জিনিস, তাই ঘোরে। আমি আরো কিছু প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম। তখনই আম্মু বিরক্ত হয়ে বললেন, বাপ মেয়ে কথাও বলতে পারে! আমি আম্মুর সেই রাগি রাগি চেহারার দিকে তাকিয়ে, ছন্দময় কী যেন একটা বানিয়ে ফেললাম। সেটা জোরে জোরে বলতে লাগলাম, পটোল আর ঝিঙে, তিড়িংবিড়িং নাচছে দেখ ছোট্ট এক ফিঙে। আম্মু হি হি করে হেসে উঠে বললেন, আমি নাকি বড় হয়ে ছড়াকার হব।

আমার অনেকগুলো খেলনা ছিল, সেই খেলনাগুলো দিয়ে আমি একা একাই খেলা করতাম। মাঝে মাঝে আম্মুও আমার সঙ্গে খেলা করতেন। একদিন আম্মুকে বললাম, আম্মু আমার একা একা খেলতে ভালো লাগে না। তুমি আমাকে একটা বন্ধু এনে দাও। এর কিছুদিন পর আম্মু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলেন, আব্বু-আম্মুকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলেন। দুই দিন পর লাল রঙের একটা গাড়িতে চড়ে আম্মুর সঙ্গে এলো ছোট্ট একটা বাবু। কী সুন্দর বাবু! আব্বু বললেন, তোমার ছোট বোন ওকে স্বাগত জানাও। আমি সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললাম, ছোট বোন তোমাকে স্বাগত। কিন্তু ঝিঙে আব্বু একটা বোন নিয়ে এসেছ কেন? আরো কয়েকটা নিয়ে আসতে! আব্বু হো হো করে হেসে উঠলেন। আমাকে কিছুই বললেন না। আমার খুব রাগ হলো, বুঝতে পারলাম না আব্বু আমাকে কেন কিছু বললেন না। গাল ফুলিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করলাম, এই গাড়িটা কী আমাদের গাড়ি? আব্বু বললেন হ্যাঁ এটা আমাদের গাড়ি। এই গাড়িটার আর কী কী রঙ ছিল? আব্বু বললেন, লাল, সাদা, হলুদ, খয়েরি ও কালো। তাহলে এটা কিনলে কেন? আব্বু বললেন, লাল তোমার পছন্দের রঙ তাই। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, আব্বু এই গাড়িটার দাম কত? আব্বু মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন, ৯০ টাকা। আমি অবাক হয়ে বললাম ৯০ টাকা! গাড়ির এত দাম! তাহলে কম দামে আরো কয়েকটা কিনতে? আব্বু এবার আমার দিকে তাকিয়ে খুব জোরে একটা হাসি দিলেন! হাসতে হাসতে বললেন, রাখব কোথায় এত গাড়ি, অনেক ছোট আমার বাড়ি। আমি আব্বুর কথা শুনে খুব মজা পেলাম! বাবুটাকে আদর করে দিয়ে বললাম, আব্বু ওর নাম কী রাখবে? তোমার নাম বর্ণা, ওর নাম রাখব স্বর্ণা। আমি বললাম, বাহ খুব সুন্দর নাম! কিন্তু তুমি আমাকে পটল বলে ডাক, তাহলে ওকে

কী বলে ডাকবে? ওকে ডাকব মুরগি ছানা। আসলেই বাবুটা ঠিক মুরগি ছানার মতোই! বেশ নরম তুলতুলে। দিন ভর অ্যাঁ অ্যাঁ করে কাঁদে। আমার ওর কান্না শুনতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু রাত হলেই সে চুপচাপ। আমি আব্বুকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা ও কান্না করছে না কেন? আব্বু বললেন ওর পিঠে ব্যাটারি ছিল, সেটা খুলে রেখেছি আবার যখন লাগিয়ে দিব তখন অ্যাঁ অ্যাঁ করে কাঁদবে। ওর পিঠে কয়টা ব্যাটারি লাগানো ছিল? আব্বু বললেন দুইটা। আমি বাবুটির পিঠে হাত দিয়ে দেখতে লাগলাম, কোথায় ব্যাটারি লাগানো আছে। আব্বু আমাকে দেখালেন, এই যে পিঠের ডান পাশে এই খানে দুইটা ব্যাটারি লাগানো ছিল। তার মানে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার পিঠেও এই রকম দুটা ব্যাটারি লাগানো ছিল! আব্বুর পিঠেও ছিল! আম্মুর পিঠেও ছিল! কি মজা হি হি।

ধীরে ধীরে ছোট্ট বাবুটা হাঁটতে শিখল, কথা বলতে শিখল। আমরা দুই বোন মিলে এখন একসঙ্গে খেলা করি, মাঝে মাঝে ঝগড়া করি। আব্বু তখন আমাদের দুই বোনকে নিয়ে মজা করে বলেন, বর্ণা-স্বর্ণা কারো থেকে কম না। এভাবেই আমরা দুবোন খেলা করতে করতে আর ঝগড়া করতে করতে বড় হয়ে গেলাম। তবে আমার কিন্তু প্রশ্ন করা এখনো শেষ হয়নি, চলছে তো চলছেই। সুযোগ পেলেই শুধু প্রশ্ন করি আর প্রশ্ন করি। প্রশ্ন করতে করতে একদিন আমার নাম হয়ে গেল প্রশ্নকন্যা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close