আরাফাত শাহীন

  ২৬ মে, ২০১৮

মায়ের দেওয়া কাজ

সূর্য পশ্চিম আকাশে পুরোপুরি হেলে পড়েছে। দিনের আর খুব বেশি সময় অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। সন্ধ্যা নেমে আসার আগে আগে যে করেই হোক পৌঁছাতে হবে। নাফিস একটি ভ্যানের আশায় পেছনদিকে তাকাল। নাহ! রাস্তায় কিচ্ছু নেই। একদম ফাঁকা। বাকি পথটা বোধহয় হেঁটেই যেতে হবে।

নাফিস ওর মামাবাড়ি যাচ্ছে। মা একটা বিশেষ কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। আবার রাতেই বাড়িতে ফিরে আসতে হবে।

বিকেলবেলা নাফিস পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। খেলা বেশ জমে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে আম্মু ডেকে পাঠিয়েছেন। নাফিস মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও আম্মুর ডাককে উপেক্ষা করতে পারেনি। নাফিস জানে, বিশেষ প্রয়োজন না হলে এখন তিনি ডেকে পাঠাতেন না।

‘দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও। তোমাকে এখনই নানুবাড়িতে যেতে হবে।’

খেলার মাঠ থেকে দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলে আম্মু বললেন। নাফিস মনে মনে কিছুটা বিস্মিত হলো। এখন মামাবাড়িতে যাওয়ার কী প্রয়োজন! নিশ্চয় জরুরি কোনো ব্যাপার। এত জরুরি যখন তখন মামাকে ফোন করে আসতে বললেই তো হয়।

‘তুমি মামাকে ফোন করে আসতে বলছো না কেন?’

নাফিস আম্মুকে বলল।

‘ফোনে অনেকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাচ্ছি না। আশপাশের কারো নম্বরও আমার কাছে নেই। তোমাকেই যেতে হবে।’

নাফিস আর কথা বাড়াল না। হাত-মুখ ধোয়ার জন্য কলের দিকে এগিয়ে গেল।

মামাকে গিয়ে কী বলতে হবে তা আম্মু ওকে ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছেন। নাফিস মায়ের বলা কথাগুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে আর পথের দিকে তাকাচ্ছে যদি কোনো যানবাহনের দেখা পাওয়া যায়! কী কুক্ষণে যে সাইকেলটা নষ্ট হয়েছিল! সাইকেল ভালো থাকলে এখন এই ভোগান্তি পোহাতে হতো না। আরামসে সাইকেলে চেপে চলে যাওয়া যেত। মামাবাড়িতে ও সাইকেলে চেপেই যায়।

এখনো বেশ খানিকটা পথ বাকি রয়েছে। নাফিস হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। বুঝতে পেরেছে কপাল খারাপ। কোনো যানবাহন আর পাওয়া যাবে না। এখন যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। হঠাৎ নাফিসের মনে একটা আশঙ্কা উঁকি দিল। মামাকে যদি গিয়ে বাড়িতে পাওয়া না যায়! মামাকে কোনো কারণে না পাওয়া গেলে কী করতে হবে আম্মু সেটা বলে দেননি। নাফিসের বেশ দুশ্চিন্তা হতে লাগল। বেশ ঝামেলাপূর্ণ একটা ব্যাপার। কেন যে তাকে এসব ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়! নাফিস হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল।

নাফিস মামাবাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছাল মসজিদ থেকে তখন মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসছে। নানা কিংবা মামাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তবে নানিকে পেয়ে গেল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর নাফিস মামা কোথায় জানতে চাইল।

‘তোমার মামা বিকেলবেলা বাজারে গেছে, এখনো ফেরেনি।’

নানি বললেন।

নাফিসের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। এখন মামাকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায়! দেরি করা ঠিক হবে না। নাফিস বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করল।

নানুবাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব আরো প্রায় দুই কিলোমিটার। এত পথ হেঁটে এসে নাফিসের এমনিতেই ক্লান্ত লাগছিল। এখন আবার বাজারে যাওয়া লাগছে। ক্লান্তিতে আর যাত্রার পরিশ্রমে ওর সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল। কোথাও বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই। আম্মু খুব জরুরি একটা কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। আব্বু বাড়িতে থাকলে তাকে এসবের কিছুই করতে হতো না। সব কাজ তিনি একাই সামলাতে পারতেন। কিন্তু আব্বু দেশে নেই। বিদেশে থাকেন। সৌদি আরবে। বাড়ির একমাত্র ছেলে হিসেবে তাই ওকে বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়।

বাজার পর্যন্ত আর যাওয়া লাগল না। অর্ধেক পথ পেরোতেই মামার দেখা পাওয়া গেল। মামা সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছেন। নাফিসকে দেখে তিনি সাইকেলের গতি কমিয়ে দিলেন।

‘কিরে, এই সন্ধেবেলা কোথায় চলছিস?’

সিটে বসা অবস্থায় মাটিতে এক পা নামাতে নামাতে মামা প্রশ্ন করলেন।

‘আপনার খোঁজে বাজারের দিকে যাচ্ছি।’

‘কেন আমাকে কী দরকার?’

‘আম্মু আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে যেতে বলেছেন।’

‘কী দরকার আপা কিছু বলেছেন নাকি?’

‘বড় আপাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আম্মু অবশ্য দিনের বেলা আসতে বলেছিল। কিন্তু ওদের নাকি কী তাড়া আছে। আপনাকে তাই যেতে বলেছে।’

‘এই কথা তো ফোনে বললেই চলত। তোকে কষ্ট করে পাঠানোর কী দরকার?’

‘ফোনে নাকি আপনাকে পাওয়া যাচ্ছে না!’

মামা পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলেন সেটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বাজারে একটা মিটিং ছিল। তখন বন্ধ করে রেখেছিল। পরে আর খুলতে মনে নেই। মামা মনে মনে অনুতপ্ত হলেন। তারপর কল দিয়ে আম্মুকে যাওয়ার কথা বললেন। নাফিসকে বললেন, ‘সাইকেলের পেছনে চড়ে বস। চল, আগে তোদের ওখানে যাওয়া যাক।’

মামার সাইকেলের পেছনে বসে বসে নাফিস আজকে বিকেল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে মনে ভাবতে লাগল। অবশেষে ওর পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। মামাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হতে পেরেছে। এখানে আসার সময় ওর অনেক কষ্ট হয়েছিল। এখন মামার সাইকেলে চেপে যেতে বেশ আরামই লাগছে। সাইকেলের পেছনে মৃদু মৃদু ঝাঁকিতে ওর বেশ ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ মামা প্রশ্ন করলেন, ‘পাত্রপক্ষ থেকে তো বেশ লোকজন আসবে। তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা কী হয়েছে?’

নাফিসের ঝিমুনি কেটে গেল।

‘আম্মু পাশের বাড়ির চাচিকে নিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’

কথা বলতে বলতে ওরা বাড়িতে এসে প্রবেশ করল। পাত্রপক্ষ এখনো এসে পৌঁছায়নি। ওরা ঠিক সময়েই চলে আসতে পেরেছে। আম্মু বেশির ভাগ ব্যবস্থাই করে রেখেছেন। যতটুকু কাজ বাকি ছিল, মামার সঙ্গে মিলে নাফিস সেটুকু করে ফেলল। আম্মু খুব খুশি হলেন। নাফিস তার ওপর দেওয়া সমস্ত কাজ ঠিকমতো করে আসতে পেরেছে। বাবার অনুপস্থিতিতে ও আম্মুকে কোনো কষ্টই বুঝতে দেয় না। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রাহেলা বেগমও খুব সন্তুষ্ট।

‘তোমার ভাগ্নেটা বড় লক্ষ্মী হয়েছে। আমাকে কোনো কষ্টই বুঝতে দেয় না।’

মামার সামনে বলা আম্মুর এই কথাগুলোয় নাফিস বেশ লজ্জা পেল। ও তো শুধু ওর ওপর দেওয়া কাজগুলো ঠিকমতো পালন করার চেষ্টা করে। আর সব সময় আম্মুর কথামতো চলার চেষ্টা করে। এ আর কী এমন বাহাদুরি!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist