অলোক আচার্য

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

বুদ্ধিজীবী হত্যা একটি ষড়যন্ত্রের অংশ

১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো নতুন এক ষড়যন্ত্র করে। মূলত যখন তারা দেখল সার্বিক পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না, পাকিস্তানের তৎকালীন মিত্র রাষ্ট্রগুলোও যখন পাকিস্তানকে আর সাহায্য করতে পারছিল না; তখনই তারা ঘৃণ্য এক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। তারা দেশের খ্যাতনামা মানুষের তালিকা তৈরি করে হত্যা করতে শুরু করে। স্বাধীন দেশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে এসব বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা একান্তভাবে প্রয়োজন। তাই আমাদের অগ্রগতিটা যেন শ্লথ হয়, সে ব্যবস্থা করতে তাদের এই হত্যাযজ্ঞ। তারা নির্মমভাবে বেছে বেছে মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করে। এই তালিকা তৈরিতেও পাকিস্তান বাহিনীকে সাহায্য করেছিল এ দেশের রাজাকাররা। মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো মেধাবীদের ওরা হত্যা করে। তারপর তাদের রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি দেশের পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে সেই কঠিন কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদি এই মেধাবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো; তাহলে দেশের অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হতো। কেননা, এই বুদ্ধিজীবীরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন এক একজন নক্ষত্র। তারা নতুন স্বাধীন দেশে যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে দেশটা আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেত।

কয়েক দিন আগে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জননী তারামন বিবি মারা গেছেন। তার আগে বিদায় নিয়েছেন একাত্তরের জননীখ্যাত রমা চৌধুরী। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন এক দিন বাঙালি দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে এঁকে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ংকর ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা। নির্মম বা নৃশংস কোনো শব্দই এই নির্মমতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। এক দিন পৃথিবীতে আমাদের সেই বীর মানুষ থাকবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের হারিয়ে ফেলব। কিন্তু তাদের স্বপ্ন, তাদের দেখানো পথ আমাদের সামনে থাকবে। স্বাধীনতা একটি স্পর্শমণি, যা প্রত্যেকেই চায়। আমরাও চেয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম আর বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ বইতে সিডনির শৈলচিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে বলেছেন, ধর্ষিতা মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক দুই লাখ হলেও তার মতে, এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, এই সংখ্যা চার থেকে চার লাখ ত্রিশ হাজারের মতো হতে পারে। তিনি আরো বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যত্ববরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছেন। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। সুতরাং পরিবার-পরিজনহীন একাকী জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এসব বীরাঙ্গনাকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। তাদের প্রাপ্য নিশ্চিত করতে হবে। যেসব মানুষ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিতে জীবনবাজি রেখেছেন, তাদের কেউ কেউ আজও অবহেলিত। দেশকে ভালোবেসে যাওয়াই তাদের একমাত্র সান্ত্বনা। কিন্তু তাদের জন্য কিছু না করতে পারটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা চাই, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যিনি এ দেশের জন্য রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখেছিলেন তিনি তার কর্মের স্বীকৃতি পান।

সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করাটা যে কতটা সৌভাগ্যের, তা কেবল স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা একটি শিশুই বলতে পারবে। যার একটি সুন্দর শৈশব থাকবে, সে নির্ভয়ে খেলা করবে, লেখাপড়া শিখবে। কারণ পৃথিবীতে আজ যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের নির্মম পরিণতি চোখের সামনে দেখছি। আমরা ফিলিস্তিনের সংগ্রাম দেখছি। এমনকি একটু বেঁচে থাকার স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে দেখছি। বহু জাতি, বহু সংগ্রাম, যুদ্ধ, রক্ত, ইজ্জত, সম্পদ হারিয়েছে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য। আমরাও করেছি। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করেছি। রক্ত দিয়েছি, সম্পদ দিয়েছি, ইজ্জত দিয়েছি। সব দিয়েছি শুধু দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন মানে আমাদের নিজস্বতা অর্জন করা। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে। ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ের ভাবসম্প্রসারণে পড়েছি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু তখন এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। কথাটির গভীরতা এখন বুঝতে পারি। স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, তা ধরে রাখা এবং মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের দেশে পরিণত করাটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। কতটা চ্যালেঞ্জের তা আমরা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারি। কারণ প্রতি পদক্ষেপে বাধা আসবে। একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য দরকার ভূখন্ড, সার্বভৌমত্ব, জনগণ ও সরকার। কিন্তু সেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন দেশপ্রেম।

স্বাধীনতার উদ্দেশ্য আজ বাধাগ্রস্ত করছে অসৎ মানুষদের অসৎ মনোভাব। একশ্রেণির অসাধু মানুষ দুর্নীতি নামক শব্দটিকে তাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। যার জাল ছিঁড়ে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। সেই জাল ছিঁড়ে মুক্ত করার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের তরুণ প্রজন্মকে। যারা এই দেশটাকে ভালোবাসে। দেশের জন্য কাঁদে। জাতীয় সংগীতে যাদের কণ্ঠ সুর মেলায়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, তাদের হাত ধরেই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা। একসময় এই দেশটা দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক সে সময়টা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আজ আর সেকথা মনে করতে চাই না। কিন্তু আর যেন বিশ্বের দরবারে আমাদের লজ্জা না পেতে হয়; সে শপথ নিতে হবে। দুর্নীতি এখনো সমাজটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সে অবস্থা থেকে বের হতে হবে। না হলে সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। যে লাল সবুজ পতাকা আমরা পেয়েছি, তা যেন সবার ওপরে নিয়ে উড়াতে পারি, সে দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। কারণ যখনই কোনো কারণে এই সোনার দেশটার দিকে বিশ্ব আঙুল তুলে অভিযোগ করে আমাদের বুঝতে হবে, তার দায় আমাদেরই। কারণ এই মানুষগুলোর জন্যই দেশটার দিকে অভিযোগ ওঠে।

ধর্মীয় সম্প্রতির এক অনন্য উদাহরেণর নাম বাংলাদেশ। সেই আদিকাল থেকেই এ দেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পাশাপাশি হাত ধরে বসবাস করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকেও একই পতাকার নিচে আমরা সবাই আজ বসবাস করছি। আমরা চাই না এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঘিরে ফেলুক। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে। স্বাধীনতার এটাও উদ্দেশ্য। দেশ নিয়ে একটি কথা আমাকে খুব টানে। সেটা হলো, দেশ তোমাকে কী দিয়েছে, তা বড় কথা নয়, তুমি দেশকে কী দিতে পেরেছ, সেটাই বড় কথা। সত্যি তো, স্বাধীনতার তো বহু বছর পার হয়ে গেল। কী দিতে পেরেছি দেশটাকে। কতটুকুইবা দিতে পেরেছি। দেশের কাছে এটা চাই, ওটা চাই, কিন্তু আমি বা আমরা কী দিচ্ছি! দেশটা তো আমাদের। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশটাকে সাময়িকভাবে অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করতে পারলেও বাস্তবিক পক্ষে আমরা আজ বহুদূর এগিয়েছি। কাউকে যে জোর করে দাবিয়ে রাখা যায় না, তা আজ প্রমাণিত। পাকিস্তান নিজেরাই তাই আজ বাংলাদেশের উন্নতি দেখে অবাক। অবাক সারা বিশ^। সেই হারানো মানুষগুলো নেই, এ কথা সত্য। কিন্তু তাদের দেখানো সেই স্বপ্ন তো হারিয়ে যায়নি। যায়নি বলেই এখনো লড়াই চলছেÑ নৈতিকতার সঙ্গে অনৈতিকতার।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close