নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৯ মার্চ, ২০২০

এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের এক বছর আজ

দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি। আগুনের সঙ্গে কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে পড়ে আশপাশের পরিবেশ। ভারি হয়ে উঠে আকাশ। ২২তলা একটি ভবনে থাকা কর্মজীবী নারী-পুরুষদের প্রাণ বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা। ভবনের কাচের দেয়াল বেয়ে নামার চেষ্টা অনেকের। হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। নিচে তাদের আর্তনাদ আর মানুষের হায় হায় চিৎকার। নানা ধরনের পরামর্শ। উত্তেজনাকর এই পরিবেশে অস্থির চারপাশ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মুহূর্তেই ছুটে আসেন। একের পর এক বাড়তে থাকে তাদের ইউনিটের সংখ্যা। সুউচ্চ ভবন হওয়ায় এসব উদ্ধারকর্মী হিমশিম খেতে থাকেন। হেলিকপ্টার দিয়ে ছাদের ওপরে পানি ছেটানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু কপ্টারের বাতাসে আগুন বাড়ায় সে চেষ্টাও বন্ধ করতে হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীদের আবার হোসপাইপ দিয়ে পানি ছোড়া আর আটকেপড়াদের উদ্ধার চেষ্টা। তীব্র তাপে গলে যেতে থাকে ভবনের বাইরের কাচ। আগুন থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন মাটিতে। চারদিকে গগনবিদারী চিৎকার। আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে পুরো পরিবেশ। যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য। এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বনানীর গত বছর আজকের এই দিনে।

রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কের এফআর টাওয়ারে গত বছরের এই দিনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ওই অগ্নিকান্ডে মুহূর্তেই ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন শতাধিক মানুষ। ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে ২৩তলা ভবনটির ৯তলা থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা আজো প্রিয়জন হারানো ব্যথায় কাঁদছেন। ভুলতে পারছেন না বিয়োগব্যথা। ওই ঘটনায় উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীও মারা যান। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন মারা যান তিনি।

ওই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে সরকার। অগ্নিকান্ডের জন্য ভবনের অনুমোদন, নকশার ত্রুটি ও অগ্নিনিরাপত্তাকে দায়ী করা হয়। এরপর নগরীর সব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নড়েচড়ে বসে সবাই। নগরীর বিভিন্ন ভবনে ‘অগ্নিকান্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ’ লেখা বিভিন্ন ব্যানার লাগিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস। রাজউক, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও নানা কর্মসূচি ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের তালিকা তৈরি করে রাজউক। কথা ছিল সেই তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। ভেঙে ফেলা হবে সব নকশাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনা।

কিন্তু অগ্নিকান্ডের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার থেমে যায় সব উদ্যোগ। এখন আর কেউ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে কথা বলেন না। অলক্ষ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ লেখা সেই সাইনবোর্ডগুলোও। সরকার শুরু থেকে জানান দিলেও শেষ অবধি প্রকাশ করা হয়নি সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাও। নকশাবহির্ভূত কোনো ভবনের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত বাদী হয়ে বনানী থানায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন। এছাড়া এফআর টাওয়ার নির্মাণে জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলা করা হয়।

বনানী থানার মামলায় এফআর টাওয়ারের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক ও ভবনের কয়েকটি ফ্লোরের মালিক বিএনপি নেতা ও শিল্পপতি তাসভীর উল ইসলামকে পুলিশ গ্রেফতার করে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অন্যদিকে দুদকের মামলায় ভবন মালিক ফারুক, বিএনপি নেতা তাসভীর উল ইসলাম, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান কে এ এম হারুন, ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপের কর্ণধার লিয়াকত আলী খান মুকুলসহ ২৩ জনকে আসামি করা হয়।

জানা গেছে, এফআর টাওয়ারটি ২৩তলা হলেও ভবনটি রাজউকের নকশায় ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদন রয়েছে। ১৯ থেকে ২৩তলা পর্যন্ত পাঁচটি ফ্লোর তাসভীর উল ইসলাম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নির্মাণ করিয়ে নিজে মালিক হয়েছেন। জাল নকশা দিয়ে ভবনের পাঁচটি ফ্লোর অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর সুরাহা হয়নি এখন পর্যন্ত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close