রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

রেমিট্যান্স বনাম নারীশ্রমিক

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। আগে শুধু পুরুষরাই কাজের জন্য বিদেশে যেতেন; কিন্তু গত এক দশকে অনেক নারীশ্রমিকও এসব দেশে বিশেষত গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করার জন্য যাচ্ছেন। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, সিরিয়ায় কর্মী পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি যৌন ও গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রির জন্য বাংলাদেশ থেকে নারীদের যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় পাচার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে র‌্যাবও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। র‌্যাবের তথ্যে, অন্তত ৪০ জনের অধিক নারীকে সিরিয়ার পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এই নারীদের ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন, সৌদি আরব, জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু দেশে নারী পাচারের ঘটনা ঘটছে। পাচার হওয়া নারীদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে বর্তমানে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন। বিদেশ ফেরত বেশ কয়েকজন নারী এই প্রতিবেদককে জানান, তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে দিনের পর দিন স্বল্প আহারে অভুক্ত রাখা হতো। অনেকেরই সেখানে বন্দি অবস্থায় দিন কাটছে। উন্নত জীবনের আশায় প্রতি বছর পরিবার-পরিজন ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে দেশ ছাড়ছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি নারীশ্রমিক। কিন্তু দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর খপ্পরে পড়ে তারা একদিকে যেমন সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সহ্য করছেন নরক যন্ত্রণা।

তথ্যানুযায়ী, গৃহশ্রমিক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজের জন্য আকর্ষণীয় বেতন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের মূলত দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি সেসব দেশের গৃহকর্তারাও বাংলাদেশি নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ করলেই নারী শ্রমিকদের ওপর নেমে আসছে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। জানা গেছে, বেতন না দিয়েই দিনের পর দিন তাদের অভুক্ত পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা প্রবাসে ভালো আছেন কি না—তা তদারকির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমনকি সেই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতাও নারীরা পাচ্ছেন না। ফলে বিদেশে অভিভাবকহীনভাবে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে এ দেশের নারী শ্রমিকদের। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে গত তিন বছরে ৩৩১ জন নারীকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বছরের জুন পর্যন্ত ৬০ নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে।

রেমিট্যান্সের অর্থ পাওয়া যায়, যাতে দেশ চলে। অথচ যখন এই নারী শ্রমিকরা বিদেশে বিপদগ্রস্ত হন এবং সহায়তা চান, তখন তারা কেন কোনো সাহায্য পান না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। নাজমা নামের এক নারী একা এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তা তো নয়। নাজমার মৃত্যু বেশি নাড়া দিয়েছে, কারণ তিনি মৃত্যুর আগে ভিডিওতে আকুতি জানিয়েছিলেন দেশে ফেরার জন্য। কেউ তখন তাকে সহায়তা করেনি। যেসব নারী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরে এসেছেন, তাদের সব সৌদি আরব থেকে নয়; জর্ডান, লেবানন, আরব আমিরাত, ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এসেছেন। তবে সৌদি আরব থেকে আসার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তাদের মৃত্যুর নানা কারণ বলা হয়েছে কিন্তু আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়। তা ছাড়া শুধু লাশ হয়েই নয়, কাজের জন্য গিয়ে পুরো সময় পার না করেই নানা ধরনের নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরে এসেছেন অনেক নারী। তবুও তারা জানেন যে বেঁচে গেছেন। নাজমার মৃত্যু সমাজে এত বেশি নাড়া দিয়েছে যে এখন বিদেশে কোনো নারী শ্রমিক আর না পাঠানোর দাবি উঠছে। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রবাসী নারী শ্রমিকরা নিজেরা কী চান, তা আমাদের জানারও চেষ্টা করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রশ্ন সামনে আসছে; নারী শ্রমিকরা প্রবাসে কাজ করার জন্য যেতে চেয়েছেন কিন্তু সেটা গৃহশ্রমিকের কাজ হবে এমন জেনে সবাই যাননি কিংবা গেলেও যাওয়ার পর সেখানকার কাজের পরিবেশ মেনে নিতে পারেননি, তা বোঝা যায় তাদের ফিরে আসার সংখ্যা দেখে। মাত্র তিন বছরে ৫ হাজার নারী শ্রমিক ফিরে এসেছেন ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার হয়ে। এ সংখ্যা আরো বাড়ছে। ২০১৯ সালেই ফেরত এসেছেন ৮০০ জন; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক লাশ।

এমনকি যারা ফিরে এসেছেন, তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল কাজের সময় ১৪ থেকে ২০ ঘণ্টা, বেতন ঠিকমতো না পাওয়া, অত্যন্ত কম বেতনে তাদের নিয়োগ করা, কোনো প্রকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকা ইত্যাদি। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল তাদের জন্য। এর সঙ্গে যৌন নির্যাতনও যুক্ত হয়েছে অনেকের ক্ষেত্রে, যা পুরো বিষয়টিকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। নিজ পরিবারের জন্য কিছু আয়-উন্নতি বাড়াতে নারীকে এত মূল্য দিতে হবে আরো একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে তা হলো, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর জন্য আলাদা চুক্তি কেন করা হলো? আমরা জানি, তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার। সৌদি আরবে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৮ শতাংশ। কাজেই সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোর আগ্রহ সরকারের থাকবে, এতে দোষের কিছু নেই। রেমিট্যান্স পেতে ভালো লাগে অথচ যাদের মাধ্যমে এ রেমিট্যান্স আসে তাদের কোনো প্রকার সহায়তা দিতে ভালো লাগে না! এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এটাও ঠিক যে, গরিব ও কম লেখাপড়া জানা নারীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র গৃহশ্রমিক ছাড়া সীমিত। তাই তারাও বাধ্য হন এ কাজ করতে। সৌদি নাগরিকরা গৃহশ্রমিক হিসেবে সহজে এবং সস্তায় নিতে পারেন বলে তাদের আগ্রহ আছে বাংলাদেশি নারীদের প্রতি। মাত্র ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ রিয়াল খরচ করে একজন বাংলাদেশি গৃহকর্মীকে কাজে নিতে পারেন তারা। নির্যাতিত নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি হলেও অন্যান্য দেশ থেকে আসছেন না এমন নয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাব অনুযায়ী সৌদি আরব থেকে ২৬, জর্ডান থেকে ৯, লেবানন থেকে ৯, আরব আমিরাত থেকে ৪, ওমান থেকে ৩ ও বিভিন্ন দেশ থেকে আরো ৯ নারীর লাশ দেশে ফিরেছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে নারীরাও প্রবাসী শ্রমিক হয়ে বিদেশে গিয়ে আয়-উপার্জন করতে চান। তারা খুবই পরিশ্রম করেন, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক থাকে না, তবুও নিজের সংসার ও সন্তানের জন্য কিছু করার উপায় হিসেবে তারা যেতে চান।

নারীদের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বছরের পর বছর তাদের সংখ্যা বাড়ছে। যেমন ২০১৪ সালে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা ছিল ৭৬ হাজার ৭, ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭১৮। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮-তে। তবে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক নির্যাতনের কারণে সেখানে নারীদের যাওয়ার হার কমে যায়। দেখার বিষয় হলো বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহশ্রমিক পাঠনোর সময় কি এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হয়? নারী শ্রমিকদের মান-সম্মান বজায় রাখা এবং জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গৃহশ্রমিক হিসেবে প্রবাসে নারীর কাজ বাড়ছে কিন্তু এখানেই নির্যাতন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশি শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক নিয়োগকারী সংস্থা, বায়রার হিসাব অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে ৮ লাখ ৬০ হাজার নারী শ্রমিক বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে গৃহশ্রমিক হিসেবে নারীদের নেওয়া শুরু হলো। প্রথমে ২০ হাজার নিলেও ২০১৭ সালে এসে মাত্র দুই বছরে তা চার গুণ বেড়ে দাঁড়াল ৮৩ হাজার। প্রশ্ন হচ্ছে, এত সংখ্যক নারী, সবাই কি জানতেন যে তাদের গৃহশ্রমিক হিসেবে নেওয়া হচ্ছে? কিন্তু এটা জানা না-জানা কি শুধুই শ্রমিক এবং প্রেরণকারী দালালের ব্যাপার? জানা গেছে, জর্ডান হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাঠানো অনেক নারী শ্রমিকের খোঁজ পাচ্ছেন না তাদের পরিবার। এমন আরো না জানা কত ঘটনাই আছে যা মানুষের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। সুতরাং এ অবস্থায় নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আরো সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কোনোভাবেই যেন কোনো নারী দালালের খপ্পরে না পড়েন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব রিক্রুটিং এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রতি অবশ্যই কঠোর নির্দেশনা থাকা দরকার। সৌদিতে নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নারীশ্রমিক,রেমিট্যান্স,অর্থনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close