সাজ্জাদ হোসেন রিজু
দৃষ্টিপাত
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিবহন শ্রমিকদের উন্নয়ন জরুরি
রাজধানী ঢাকার জানজট সমস্যার সমাধান খুঁজতে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বেশ কিছু নির্দেশনা ও সেগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভাব্য নিয়ে আলোচনা হয় বলে গণমাধ্যমে আমরা জেনেছি। প্রস্তাবগুলোর পাশাপাশি আমাদের একমত হওয়া দরকার যে, আমরা আসলেই সড়কপথে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাই। তা না হলে সব পরিকল্পনা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
সে ক্ষেত্রে সড়কে যারা কাজ করেন, সেসব ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের মানোন্নয়ন ছাড়া সড়কপথে শৃঙ্খলা ফেরানো কষ্টকর হবে। কারণ সচেতন ব্যক্তি ছাড়া পরিবেশের উন্নয়ন অসম্ভব, যা আমাদের বিদ্যমান আইনেই বলা রয়েছে। আইনের কথাগুলো বলার আগে বাংলাদেশে ড্রাইভিং পেশা নিয়ে কিছু বলতে চাই। যদি প্রশ্ন করা হয়, পেশা হিসেবে ড্রাইভিং কতটা সম্মানের? এক কথায় উত্তর আসবে, এটি মোটেও সম্মানজনক পেশা নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উত্তরটি সঠিক। কিন্তু সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে গেলে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবদানের মাপকাঠি বিবেচনায় ড্রাইভিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশা।
দেশের গণপরিবহন খাতের (যাত্রী ও মালবাহী) ভিত্তিই দাঁড়িয়ে আছে এই ড্রাইভারদের অবদানের ওপর ভিত্তি করে। এ দেশের সস্তা ও সহজলভ্য শ্রম বাজারের কারণে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপার খুঁজে পাওয়াটা খুবই সোজা। যে কেউ চাইলেই সহজে কোনো মতে ড্রাইভিং শিখে এই পেশায় নেমে পড়তে পারে আবার কম বেতনে যথেচ্ছভাবে তাদের খাটিয়েও নেওয়া যায়। ফলে আমাদের দেশে ড্রাইভিং পুরোপুরি শ্রমিক শ্রেণির পেশা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অথচ আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি অর্থাৎ ড্রাইভারদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম, ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাস, মোটরযান চালনার যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াসহ আরো বেশ কিছু টেকনিক্যাল ও নন-টেকনিক্যাল বিষয়াদি উত্তীর্ণ হয়ে মোটরযান নিয়ে রাস্তায় নামার কথা (সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮, দ্বিতীয় অধ্যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান), যা বাংলাদেশে কখনোই পরিপালন হয়নি।
যদি যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রসঙ্গ আসে, তাহলে ড্রাইভারদের যোগ্যতা ও দক্ষতাকে আর দশটি পেশার সঙ্গে তুলনা করে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এভাবে কখনোই ভাবা হয়নি বলেই এই পেশা মানসম্মত পেশা না হয়ে ধীরে ধীরে শ্রমিক শ্রেণির পেশা হিসেবে অবমূল্যায়িত হয়েছে। আজ একজন নিরক্ষর কিশোর ছেলের হাতে আমরা বাসের স্টিয়ারিং তুলে দিয়ে নিজেদেরই ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি। ঢাকা মহনগরীতে বহু লেগুনা বা টেম্পোচালক আছে, যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স তো দূরের কথা ১৮ বছরই পূর্ণ হয়নি। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে সড়কপথে কীভাবে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব? জানজট নিরসনের আগে সড়কের পরিবেশের প্রতি নজর দেওয়াটাই কি সমীচীন ছিল না?
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর চতুর্থ অধ্যায়ে মোটরযানের ফিটনেস সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা আছে। এটাও বলা আছে, ফিটনেসের অনুপযোগী কোনো মোটরযানের ক্ষেত্রে ফিটনেস সনদ দেওয়া হলে সনদ প্রদানকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। আইনের এক শর্তই যদি সঠিকভাবে পরিপালন হতো, তাহলে ঢাকা মহনগরীতে প্রায় অর্ধেকের বেশি যানবাহন রাস্তায় চলাচলের যোগ্যতা হারাত। আর যেসব কর্মকর্তা এসব যানবাহনের লাইসেন্স দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি। ওই আইনের, ষষ্ঠ অধ্যায় অনুযায়ী মহাসড়কের ঢাল থেকে উভয় পাশে ১০ মিটারের মধ্যে অবৈধভাবে কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী স্থাপনা (যেমন : হাটবাজার, দোকান ইত্যাদি) নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় এসব অনিয়ম চললেও কখনোই কোনো অবাঞ্ছিত স্থাপনা উচ্ছেদে কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
আমরা ফুটপাতে হাঁটতে চাই, কিন্তু ফুটপাতে অবৈধ দখলের কারণে তা পারি না, ফলে এই চাপটি মূল সড়কের ওপরেই এসে পড়ছে। ফুটপাত অবৈধ দখলের ফলে মূল সড়ক সরু হয়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, এটি বোঝাতে নিশ্চয়ই প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। এসব অনিয়ম ছাড়াও সড়কে চাঁদাবাজি, গণপরিবহনের আসনসংখ্যা ও নির্ধারিত ভাড়া মেনে না চলা, যেখানে-সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা শ্রম নিশ্চিত না করা এবং যথাযথভাবে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর এবং হেলপারদের নিয়োগপত্র প্রদান না করা, প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা না করে যথেচ্ছভাবে যানবাহনের নিবন্ধন প্রদান করা ইত্যাদি তো আছেই। ফলে দেশের গণপরিবহন (যাত্রী ও মালবাহী) একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
যেমন : অবিলম্বে, নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, টেম্পো ইত্যাদি মোটরযান রাস্তা থেকে উঠিয়ে দিতে হবে। মোটরচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রধান সড়কে পায়ে চালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করতে হবে, রিকশা চলবে মহল্লার অলিগলিতে। স্বল্প দূরত্বের জন্য টেম্পো বা লেগুনা এবং বেশি দূরত্বের জন্য বাস রুটের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে গণপরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। এতে করে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার হ্রাস পাবে। বাস থাকবে একেকটি কোম্পানির অধীনে এবং যেখানে কর্মরত প্রতিটি ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে। টেম্পো ও অটোরিকশা থাকবে ব্যক্তিগত কিন্তু তা অবশ্যই লাইসেন্স ও রুট পারমিটের আওতায় থাকবে। রুট পারমিটের আওতার বাইরের এলাকায় চালানোর সুযোগ থাকবে না। পরিবহন সেক্টরে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। নতুন যানবাহন ক্রয়ের জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো দ্রুত সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। সর্বোপরি, ড্রাইভিং পেশাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে শিক্ষিত ও সচেতন উদ্যোক্তারা এই পেশায় এগিয়ে আসেন এবং রাস্তায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়। অতএব মনে রাখতে হবে, পরিবহন শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন ছাড়া গণপরিবহনের শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব নয়।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
"