নিজস্ব প্রতিবেদক
খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে ব্যাংক
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বছরের শেষ দিকে মুনাফা প্রবৃদ্ধিসহ আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনে ব্যাংকগুলো। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কিছু ঋণ পুনঃতফসিল করে। আবার কোনও ব্যাংক তথ্য গোপন করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখায়। এমন চালাকির আশ্রয় না নিতে সরকারি চার ব্যাংকে চিঠিও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ ফেরত না দিলে ওই ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে যে সব খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়, সেই ঋণগুলোকে তখন আর খেলাপি বলার সুযোগ থাকে না। এই সুবিধা নিতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত হিসাব করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ঋণগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে দেখেছে।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে চার হাজার ৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করেছে রাষ্ট্রায়ত্ব চার ব্যাংক। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক এক হাজার ৭৭১ কোটি, অগ্রণী ৯২৭ কোটি, রূপালী ৬৯১ কোটি ও সোনালী ব্যাংক ৬৮২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ গোপন করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরী করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি, ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ছিল ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ নিয়ে কোনও চালাকির আশ্রয় না নিতে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি, এর আগে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে এক প্রার্থীর খেলাপি ঋণের বিষয়ে চতুরতার আশ্রয় নেওয়ার কারণে জনতা ব্যাংককে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠিয়েছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নোটিশে বলা হয়েছে, বিধি মোতাবেক প্রতিটি ঋণের ক্ষেত্রে বস্তুগত মাপকাঠি ও গুণগত মান উভয় ভিত্তিতে প্রাথমিক শ্রেণিমান নির্ধারণ করার নিয়ম ছিল। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক এই নিয়ম না মেনে আর্থিক বিবরণী তৈরি করেছে। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বিবরণীতে উঠে আসেনি বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, ৯২৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছিল অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটি তাদের পাঠানো হিসাবে ২৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে পাঁচ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে দেখায়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে আরও ৯২৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পায়।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম বলেন, গুণগত বিচারে যে ঋণগুলোকে আমরা খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। পরে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মোতাবেক সেগুলো উপস্থাপন করেছি।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ৩৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করে জনতা ব্যাংক। কিন্তু জনতা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা পরিদর্শন করে আরও এক হাজার ৭৭১ কোটি খেলাপি ঋণ খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। রূপালী ব্যাংক দুই হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ দেখালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি পেয়েছে তিন হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক তাদের দেওয়া হিসাবে ১০ হাজার ২২৯ কোটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে আরও ৬৮২ কোটি টাকা বেশি পেয়েছে।
তবে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘ইচ্ছেকৃতভাবে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করলে সেটাও চালাকি বলেই গণ্য হবে। তবে পুনঃতফসিল সংক্রান্ত জটিলতায় খেলাপি ঋণ অনেক সময় নিয়মিত ঋণে রূপ নেয়। এ ধরণের অসঙ্গতির প্রবণতাকে চতুরতা বলা ঠিক হবে না।’
"