সোহেল মাজহার

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২২

ধারাবাহিক রচনা- ১৮

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

আহমদ ছফার অলাতচক্র : আহমদ ছফা একাধারে সাহিত্যিক, সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রবিশ্লেষক। তিনি ঘটনা-ঘটনাসমূহের পারিপার্শ্বিক সমাজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন বাস্তবতার আড়ালে যে নিহিত সত্য লুকিয়ে থাকে, তার অনুসন্ধান করেন। সমাজের পরস্পর নির্ভরশীল আর্থসামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক, ভূ-বৈশিষ্ট্যগত ও রাজনৈতিক উপাদান পরস্পরের হয়ে প্রভাব বিস্তার, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে মানস চেতনায় আলোড়ন তোলা-ই তার লেখার মূল উপজীব্য।

আহমদ ছফার উপন্যাস অলাতচক্র। অলাতচক্রের আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, সুদীর্ঘকালের ইতিহাসের পথ বেয়ে বাঙালি জনজাতি শোষণ, বঞ্চনা ও পরাধীনতার চক্রব্যূহের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, সে অলঙ্গনীয় সীমারেখার দিকনির্দেশ করছে। মহাভারত মহাকাব্যে অভিমন্যু একটি চক্রব্যূহে আটকে পড়েন। কিন্তু বাঙালি জনজাতি পরাধীনতার চক্রব্যূহের সীমারেখা অতিক্রম করে মুক্তি পথের দিকে দৃকপাত করে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দানিয়েল ও তায়েবা। দানিয়েল ও তায়েবার হৃদয়ঘটিত অনুভবের যে তীক্ষè অনুভূতি- তার সঙ্গে বাঙালির গণমানুষের মুক্তি-স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা একাকার হয়ে যায়। উপন্যাসটির মূল কত্থক দানিয়েল। দানিয়েলের বয়ানে মানুষের ব্যক্তিগত আবেগণ্ডঅনুভূতি, সংকটের নানা মাত্রা পারস্পর্য তুলে ধরতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ, ঘটনার ভেতরের ঘটনা, সংশয়-দোদুল্যমানতাণ্ডসম্ভাবনাকে চিহ্নিত করেন। ভারতের কলকাতা শহরে উদ্বাস্তু হিসেবে আসা দানিয়েল দেশের মুক্তি ও নিজের বেঁচে থাকার তাগিদের পাশাপাশি তায়েবার সান্নিধ্যের তাগিদও হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করেন। দানিয়েল কিন্তু কোনো গড়পড়তা মানুষ নয়, লেখক তাকে সৃষ্টি করেছেন একজন চিন্তাশীল, অগ্রবর্তী ভাবনা, সমাজ, রাজনীতি-রাষ্ট্র চিন্তক ও সাহিত্যমনস্ক মানুষ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে চরিত্রকে লেখকের প্রতিরূপণ্ডপ্রতিছায়া হিসেবে ভাবা যায়। স্বভাবত মুক্তিযুদ্ধের একজন সাধারণ মানুষের ভেতর যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, দানিয়েলের ওপর অভিঘাত তা থেকে একটু ভিন্ন রকম। আবার তায়েবা ঠিক সাধারণ কোনো নারী নয়। তার পারিবারিক আবহের ভেতর ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা-অনুশীলন, প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে ব্যক্তিত্ব, উদারতা, রুচি ও সৌন্দর্যের সমন্বিত ধারা তার মধ্যে প্রবহমান। তাই খুব সহজেই দানিয়েলের মতো আপাতদৃষ্টিতে উদাসীন কিন্তু সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সে সমর্থ হয়। তায়েবার আপাত কঠিন প্রাণের আড়ালে একজন প্রেমাসক্ত কোমল নারী হৃদয়ের বাস। উচ্চসংস্কৃতিচর্চা, রুচি-ব্যক্তিত্ববোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সে তার জীবন পরিপার্শ্বকে বিচার করতে শিখেছিল।

সুভাষ বসুর একজন অনুসারী মুক্তিযুদ্ধের আবেগে দীর্ঘদিন পর ফ্রান্স থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। তার পূর্ব ধারণা অনুশীলন, যুগান্তর পার্টির প্রভাবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিব সম্পর্কে তার সম্পূর্ণ নতুন মূল্যায়ন তৈরি হয়। শেখ মুজিব সম্পর্কে প্রমোদ বাবুর দৃষ্টিভঙ্গি লেখক তুলে ধরেন এভাবে- ‘মুক্তিযুদ্ধ যদি জয়যুক্ত হয় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানেন এটা বিরাট ব্যাপার। বাংলার ইতিহাসে আমি যতদূর জানি, এই ভূ-খণ্ডে বিক্ষোভ বিদ্রোহের অন্ত নেই। কিন্তু বাঙালি আপন প্রতিভা বলে নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারে তাহলে একটা অভিনব ব্যাপার হবে। কলকাতায় খোঁজখবর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তা থেকে স্থির কোনো ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন মুজিব একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সোহরাওয়ার্দীর চ্যালা ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি মহাত্মাজির মন্ত্রশিষ্য। অহিংস অসহযোগ নীতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এই বিরাট গণসংগ্রাম রচনা করেছেন। দু-চারজন কমিউনিস্ট বন্ধুর কাছে জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি তাতে সংশয়টা আরো বেড়ে গেল। মুজিব নাকি ঘোরতরো কমিউনিস্টবিরোধী। মুজিব লোকটা কেমন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কী সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আমার কাছে সবটা ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়া ছায়া মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষটার ভেতর নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নইলে তাঁর ডাকে এতগুলো মানুষ বেরিয়ে এলো কেমন করে।’ (পৃষ্ঠা ১০৩, অলাতচক্র : আহমদ ছফা, জুন ২০০০, শ্রী প্রকাশ, ঢাকা)। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু এক ব্যক্তিত্ব যার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয় তৈরি হলেও তাকে বা তার নেতৃত্ব অস্বীকার করা যায়নি। শুধু পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গেরও তিনি মহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। পশ্চিম বাংলায়ও তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক মানুষও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আকুল হয়।

এক অর্থে এই মূল্যায়ন লেখকেরই মূল্যায়ন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর যেমন দেবত্ব আরোপ করেননি, তেমনি শেখ মুজিবের অতুলনীয় নেতৃত্ব, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, নিরঙ্কুশ প্রভাব ও নেতৃত্ব গুণকেও অস্বীকার করেননি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে তার একটি ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া প্রমোদ বাবু চিহ্নিত করেন। প্রমোদ বাবুর মূল্যায়ন- ‘বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র জন্ম নিতে যাচ্ছে। এ কথা যদি বলি আশা করি অন্যায় হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তারপরে ভারতকে একই সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আঞ্চলিক, জাতিগত, ধর্ম এবং ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার দায় মেটাতে গিয়ে ভারতবর্ষের কর্তাব্যক্তিদের হিমশিম খেতে হবে। এমনকি ভারতের ঐক্যও বিপন্ন হতে পারে।’ (পৃষ্ঠা ১০৪, অলাতচক্র।) উপমহাদেশের আঞ্চলিক পরিসরে একটি ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক রাষ্ট্র সৃষ্টির উদাহরণ কেবল বাংলাদেশই সৃষ্টি করতে পেরেছিল। ভারতের ভয় থাকলেও বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে ভারতের আর কিছু করার থাকেনি।

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ অলাতচক্র উপন্যাসের নায়িকা তায়েবার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। একই তারিখে ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। একদিকে দানিয়েলের ব্যক্তিগত জীবন নিয়তির চক্রে চিরতরে আবদ্ধ হয়। অন্যদিকে তার সামষ্টিক জীবনে বাংলাদেশের জাতীয় জীবন হাজার বছরের চক্রব্যূহ অতিক্রমের সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অভিমন্যু নয় তিনি মহাভারতে অর্জুন, তার নেতৃত্বেই বাঙালি হাজার বছরের পরাধীনতার চক্রব্যূহ ভাঙতে পেরেছে। তিনি দেশি-বিদেশি, আন্তর্জাতিক সব পর্যায়ের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছেন। বস্তুত লেখক উপন্যাসে একটি গতিশীল ভাষা ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের

বিভিন্ন চক্রব্যূহ, চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে নিয়তি ব্যূহকে চিহ্নিত করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close