দিলারা মেসবাহ

  ১০ মে, ২০২৪

ঘাসের পাণ্ডুলিপি

গল্পের জন্মকথা

একসময় বনানীর বাংলোয় প্রচুর ঘাস জন্মাত। লনমোয়ার দিয়ে ছেঁটে রাখা হতো। ঝাপড়া আমগাছের তলার নধর ঘাসগুলো ছাঁটা হতো না। ঘাসুড়ে আসত। বস্তা, কাস্তে হাতে। কিন্তু কিছু ঘাস সে ছুঁয়েও দেখত না। পরে জেনেছি, সব জাতের ঘাস গরু খায় না। ক্রমে ঘাস বিষয়ে কৌতূহল জন্মাল। এর আগে অন্য কোয়ার্টারে গাভি, ঘাস ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে বৈকি। নানা জাতের ঘাস, ওলারস খেসারি খৈল ভুসির বহু বিচিত্র পরিবেশনার শিল্প মুগ্ধ করেছে।

আলীর কাস্তের জাদুবিদ্যায় মালিকের গাভির ওলান দুগ্ধভারে গহীন হয়ে ওঠে। আলীর একরত্তি সাধ কচুর শাক, ইলিশের কাঁটার ঘণ্ট কোনো অন্ধকারে গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এসব আহাজারি বহাল থাকে!

সকাল থেকে আকাশটা মুখ কালো করে রেখেছিল। ঝামা ইটের মতো কালো। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল এতক্ষণে- তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির তোড়ে ঘরবাড়ি যেন ভেসে যাবে। সাহেব আলীর মন উচাটন- ভয়ানক উচাটন। সে ঘরবার করছে। বেলা তো মন্দ হলো না। গোয়ালে একপাল গরু, ঘাস কাটার বেলা বয়ে যায়। খড় কুঁচিয়ে চাড়ি ভরে দেওয়ার সময়ও হয়ে এলো। হায় আল্লাহ! গরুগুলো না খেতে পেয়ে এতক্ষণে হাম্বা-হাম্বা করে দুনিয়া অন্ধকার করে দিচ্ছে বুঝি!...

একবার যদি মীর হোসেনের খেয়াল আসে যে, তার সাধের মূলতানি সিন্ধি গাই, নধরকান্তি বাছুর, হালের বলদগুলো বাসি পেটে আছে, তো সাহেব আলীর দশা ঠান্ডা। বিশ কদম ফেললেই তার মালিকের গোয়াল। অথচ বৃষ্টি যেন ওই আকাশটা উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে- দিচ্ছে তো দিচ্ছেই।

গালও পারতে পারে সাহেব আলীর মনিব। ওরে আল্লাহ! থামাথামির বালাই নাই। শেষমেষ ঠোঁটে ফেঁপড়ি উঠে যায়। এইটাই মনিবের বড় দোষ। বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর নাড়ি ধরে টান মারে। ঝাঁঝের সঙ্গে দু-একটা গাল দিলেই তো সাহেব আলীর মাথার রক্ত চড়ে যায়, কান ঝাঁ-ঝাঁ করে। ওদিকে তার মনিব দীর্ঘ গালিগালাজ পাড়তে পাড়তে নিজেই পুরোনো আরাম কেদারায় শুয়ে হাঁফাতে থাকে। কী গাল পাড়ার ছিরি! ‘গোলামের পুত গোলাম, ঘাস্যাড়্যার নাতি বড়লাট’। শেষে হাঁফাতে হাঁফাতে গড়গড়া টানে। তার আবার রক্ত চড়ার ব্যারাম আছে। বুকের মধ্যেও কী যেন একটা ব্যারাম ধরা পড়েছে। ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে হলো কতদিন। ওষুধপথ্য খেয়ে এখন একটু আরাম। আশ্চর্যের কথা এই যে, ঘাসুড়ে সাহেব আলীর গরুগুলোর জন্যে দরদ মালিকের চেয়ে কম না। সে কথা সংসারে কে বোঝে!...

ঘাসকাটা কামলার বৃষ্টির পানিতে ভয়! ইদানীং নতুন এক আলামত। ব্যাঙের সর্দি হয় না অথচ আজকাল ঘাসুড়ে সাহেব আলী বৃষ্টির পানি ভয় পায়। আগের মতো সয় না। দু-একবার ভিজলেই হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করতে করতে চ্যাপ্টা কিসিমের নাকটা ফুলে ভাওয়া ব্যাঙের মতো হয়ে যায়। নাকের পাটা কামড়াতে থাকে, সমানে নোনতা পানি ঝরতে থাকে। চোখ টিস-টিস করে। মাথার শিরা টাটাতে থাকে। সে এক বড়লোকি কেচ্ছা। গরিব গুবরা মানুষের ঘোড়ারোগ আর কী।

বৃষ্টিটা একটু ধরে আসতে মাথালটা সাবধানে মাথায় বসায় আলী। বৃষ্টির ছিটা থেকে মাথাটা বাঁচানো দরকার। হরিণাকুণ্ডুর হাট থেকে কেনা ঘাসকাটার নতুন কাস্তে জোড়া ঘরের আড়া থেকে টেনে নেয়। তারপর সদ্য পান্তা খাওয়া মুখে এক চিলতে কাঁচা সুপারি, আধখান পান, এক চিমটি চুন, এক চিমনটি দোক্তা জড়িয়ে মুখে ফেলে। সুরাতন কোলের ছেলেটাকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। সে শেষরাতে উঠে ভ্যাবানি শুরু করেছিল। এখন একটু না ঘুমালে সংসারের ছ্যাড়ানি গুছানো সম্ভব না। বউয়ের দিকে তাকিয়ে বিদায়ের ভঙ্গিতে নতুন কাস্তেটা নেড়ে সাহেব আলী বলে, ‘গেলাম বউ।’...

বড় বিলের ধারে গাবগাছগুরো বরাবর মোল্লাবাড়ির পাটখেতে শামা ঘাসের সবুজ সবুজ থোপা। গোয়ালে ঢুকে ভাঙা ডোলটার ওপর থেকে ভাঁজ করা ছালা দুটো টেনে নিয়ে দ্রত হাঁটতে শুরু করে সাহেব আলী। এক ছালা ঘাস ভরে বুক ভরে শ্বাস নেয় সাহেব। আরো দুই ছালা শামা ঘাস লকলক করছে। দ্রত মীরবাড়ির দিকে হাঁটে সে। পা চালায় জোরে আরো জোরে। দুধের গাই, হালের বলদ এদের কী পেটের খিদা সয়? আহা রে! বেলা কত হয়েছে!

মেশিনের মতো হাত চালিয়ে চাড়িগুলা পরিষ্কার করে সে। গরুর প্রিয় নরম তুলা তুলা শামা ঘাসগুলো গোছ মিছিল করে গুছিয়ে দেয় আলী সকালের নাশতা।

ঘচাঘচ ঘচাঘচ নরম লকলকে ঘাস কাটতে কাটতে চোখে শুধু আদরের গাই, হালের বলদগুলোর ড্যাবড্যাবে চোখ আর করুণ হাম্বা রবের কথাই মনে পড়ছিল আর বুকটা পুড়ে পুড়ে যাচ্ছিল সাহেব আলীর। এত বেলা হয় নাই বুঝি কোনো দিন। আহা বোবা প্রাণী! ছটফটে হাতে ঘাস কাটছিল আলী। মন এলোমেলা- কতক্ষণে ছুটবে গোয়ালমুখী।...

গোয়াল ঘেঁষে নয়নতারার ঝোঁপ বরাবর ডগডগ করছে সবুজ সবুজ ঢলঢলে পাতার কচুগাছ। কতদিন ভেবেছে হাট থেকে একটা ইলিশ কিনবে আর তার মাথা লেজা কাটাকুটা দিয়ে কচুঘণ্ট করতে বলবে বউকে। রান্দুনিবাটা দিয়ে সে ঘণ্টের স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। মায়ের হাতের সেই কচু-ইলিশের ঘণ্ট! প্রত্যেক বর্ষায় লকলকে কচু-লতাগুলো দেখলে পুরোনো রসনা উথলে উঠে সাহেব আলীর।

বেহুদা খায়েশ মাথা ঝাঁকিয়ে গোয়ালে ঢোকে সাহেব আলী। কাজলি, শাবানা, ববিতা, রূপসী, নয়নতারা, রূপবান কত নামের দুধেল গাইগুলো, দেখভালের সব দায় তার। হালের বলদগুলোর ভালো যত্নআত্তি করতে হয়, পেট ভরে খানাদানা দিতে হয়। গরুর পেট ভরানোর জাদু, মন ভরানোর তরিকা জানা আছে সাহেব আলীর- রক্তমজ্জায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

আমন ধানের বিচালি দিয়ে মহাযজ্ঞে মস্ত খড়ের পালা বানিয়ে রেখেছে আলী। ছোট্ট পিরামিডের আদল। সোনালি রং শুকনো ঠনটনে। সাহেব আলী পালা থেকে কয়েক গোছা খড় নামায় অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায়। কুচিকুচি করে কেটে খৈল মিলিয়ে এমন যত্ন করে চাড়ির ভেতর পরিবেশন করে যে গোগ্রাসে গিলতে থাকে কাজলি রূপসীরা।...

ওদের জিহ্বার স্বাদটা ভালো বোঝে সাহেব আলী। একবার তার মেয়াদি জ্বর হয়েছিল। নতুন ঘাসুড়ে রেখেছিল মনিব। দুই সপ্তাহের মাথায় গরুগুলোর চেহারার বিতিকিচ্ছিরি দশা। নিমাইচরার খলিলুল্লাহকে পনেরো দিনের মাথায় মালিক তাড়িয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে উপস্থিত সাহেবের ভাঙা দুয়ারে। সুরাতন ব্যস্ত হয়ে ভাঙা জলচৌকি পেতে দেয়। পুরোনো কাঁসার গেলাস মেজে পানি, বাতাসা খেতে দেয়। কী করবে না করবে দিশা পায় না। মালিক সরকারি পাস করা ডাক্তার লাগিয়ে চিকিৎসা করাল। ডজন ডজন কলা, দোনা ভরে দুধ পাঠিয়ে পাঠিয়ে আলীকে খাড়া করিয়ে গোয়ালে পাঠাল।

তখন কার্তিক আশ্বিনের মঙ্গা দেশে। মনে পড়লে আজও মুচকি মুচকি হাসে সাহেব আলী ‘হুহু বিলাই দিয়া লাঙল টানা যায় না মালিক। বোঝেন তো?...

সবাই কী ঘাসের জাত চেনে? পোকামাকড়ের বিষ চেনে? দুধেল গাইয়ের যত্ন বোঝে? বিদেশি গাই যা ইচ্ছা লতামোথা দিয়ে চাড়ি সাজিয়ে দিলেই মুখ চাগিয়ে চাবানি শুরু করে না। শুঁকেও দেখে না।

অত সস্তা না। সবকিছুরই এলেম লাগে। দিশা লাগে। জোর নিয়ত লাগে আর লাগে পরিষ্কার মন।’

ফিসফিস করে সাহেব আলী, তার দাদা ছিল পাক্কা ঘাসুড়ে। চোখের পলকে ঘাস কেটে সবুজ পাহাড় বানাত বুড়ো মানুষটা। কোন কোন মুল্লুক থেকে অমন ঝলমলা ঘাসের ডগা কেটে আনত। দাদা তার ঘাসের গুণাগুণ জানত, ঘাসের শত্রু কীটপতঙ্গ চিনত। এক ঝলক দেখেই সব বুঝে নিতে পারত মানুষটা। সেই রক্তের বিছন সাহেব আলীর রক্তে থইথই করে।

মীরবাড়ির গোয়ালঘরের লাগোয়া ঘাসুড়ে সাহেব আলীর একফালি ঘর, বিশ্রামের ছাউনি। ছোট্ট একটা জলচৌকি। কাঁথা মাথার বালিশ। একটা আয়নাও ঝুলানো আছে টিনের দেয়ালে। চিরুনি, লাইফবয় সাবান, আকিজ বিড়ির ভাঙা প্যাকেট, প্রজাপতি মার্কা ম্যাচবাতি, কাসাসুল আম্বিয়া, সোনাভানের সস্তা চটি বই, ছায়াছবির গানের বই, আছে সাহেব আলীর বিনোদনের জগতে।...

বেলা অনেক হয়ে গেছে।...ঘাটে যেতে হবে। বড়পুকুরের ঘাটলায় আজ মেলা ভিড়ভাট্টা। ঘাটলার শেষ ধাপে গামছা দিয়ে গা ডলতে ডলতে মাইনক্যা দাঁত কেলিয়ে হাসে, আচানক!

‘সাহেব আলী ভাই ঘাস কাইট্যা কাইট্যা দিন ডুবাইল্যা। দিনমান ঘাড় গোঁজ কর‌্যা খালি ঘাস কাট। ওবা কাম সগলেই পারে।’

সাহেব আলী অমন গায়েপড়া খোঁচা খেয়ে অপমান বোধ করে না বরং প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে ঘাড় শক্ত করে জবাব দেয়,

‘মাইনক্যা! তুই একটা বলদা, তাই কইতে পারলি। গরুর জন্যে ঘাস কাইটা আনাডা কঠিন কিছু না। তুই কইতে পারলি। তুই বুঝবি না- কোন সুময় কোন ঘাস গত্তি খায়, কোন ঘাস খায় না। আবার কোন ঘাস খাইলে অসুখ হয় না, এডাও জানা লাগে। এগুলো বহুত ভ্যাজালের বিষয়।’

মাইনক্যা সাইকেলের দোকানে মেরামতির কাজ করে। তার গর্ব অন্যরকম।

সে কালো মুখে দাঁত ঝিকিয়ে হাসতেই থাকে।

লাইফবয়ের ফেনা তোলে আলী। মনডা বহুত বিষ করে। অকাট মূর্খের দল। সাইকেলের ভাঙা স্পোক মেরামত, টায়ারে হাওয়া দিতে দিতে মনটাও হয়েছে রসকষহীন। মুখে চোখা চোখা বাক্যবাণ ভাঙা স্পোকের চেয়ে তীক্ষè। কেউ জানে না সবুজ ঘাস, সোনা রং বিচালি, খৈল ভুসির ভুরভুরে গন্ধ শুঁকে শুঁকে সাহেব আলীর মনের মধ্যে এক গাঢ় রসের ফল্লুধারা বয়। যেন সে মৃত্তিকার গন্ধবিভোর এক মহান শিল্পী, এক নীরব সাধক।

সাহেব কত মমতায়, কত যত্নে কাস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাটে নানা জাতের ঘাসের সবুজ সবুজ ডগা। দুবলা ঘাস, ভ্যাদলা ঘাস, চেঁচরি ঘাস, ব্যাঙথুবড়ি ঘাস।...কোন মুল্লুক মুল্লুক ছালা কাঁধে ছোটে সাহেব আলী।

গত রবিবার দিন প্রচুর ভ্যাদলা ঘাস কেটে এনেছিল চরতিতুলিয়া থেকে।

দু’ঝুড়ি ঘাস বাঁকে করে কাঁধে ঝুলিয়ে গোয়ালের সামনে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাহেব আলী। মনে হয় গোয়ালে ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে চেয়ে হাসছিল কাজলি, নয়নতারা, রূপসীরা। খুশির ছোট ছোট ঢেউ ভাঙের ওর বুকে।

‘আল্লাহ দিলে কাজকামে বুইটলামি শিকি নাই।’ নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলে আলী।

ভাত-ঘুমটুকুণ্ডগা ঝাড়া দিয়ে সাহেব ঘাস কাটে মিয়া বাড়ির দক্ষিণ মুড়ার উঁচা জমির কোল ঘেঁষে। সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেছে মীরবাড়ির কুটুমের মতো পুরোনা ঘাসুড়ে কামলা, যশোরে মণিরামপুর থানার মোবারকপুর গাঁয়ের ঘরজামাই মবিন মিয়া। আকিজ বিড়ির ধোঁয়া উড়িয়ে পণ্ডিতি করে,

‘ঘাসের ওপর গ্যাজা গ্যাজা দাগ, এডা কী কও তো?’

সাহেব আলী অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে,

‘এড়া বিষ।’

মনিব মিয়া পরাজিত।

তার গলার ভেতর খুশখুশ করে,

‘এড়া বিষ কী?’

গম্ভীর মুখ জুড়ে এক ধরনের বিরক্তি।

‘ক্যা? ঘাসফড়িং বা অন্যকোনো জাতের পোহামাহড়ের বিষ লালা। ও আমরা গরুক খাওয়াই না মবিন ভাই। গরুর গা ফুলে যায় ঢোল হয়্যা। সেবার রেশমবাড়ির ছেড়াডা ওই বিষ খাওয়াইযা কাজলির শরীরে ঘা বানাইয়া দিছিল না।’

মন্ত্রের মতো আওড়ায় সাহেব আলী। শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ির সাহেব আলী কম ওস্তাদ নাকি? গালগল্পে অনেক টাইম নষ্ট। তাড়াতাড়ি থুবড়ি ঘাসগুলো জড়ো করে ছালা বাঁধে আলী। হালের গরুগুলোর শেষরাতে খাবার দিতে হয়। কাজ কী তার কম ঘণ্টা মাপা কম? সাহেব জানে মনিব তার ওপর খুব ভরসা করে। তবু মনিবরা অমন গালমন্দ করেই থাহে, ‘ওডা তাগরে স্বভাব।’...মনে মনে হাসে সে।

‘ব্যাগর ব্যাগর না কল্লি প্যাটের বাত অজম অয় না। কামলা মানুষেক সব সম শক্ত তরিকার মইধ্যে রাহা লাগে।’...

অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শনের মেঘে ছেয়ে যায় আলীর কাজপাগল চিত্ত। আপনমনে হাসে সে।

পুরোনো দিনের কত কথাই মনে পড়ে। দু-একটা ভুলচুক তারও কী হয়নি? একবার বর্ষাকালে মুলতানি গাই কাজলিরে আলী চাড়িবোঝাই করে শুধু কচুরিপানা খেতে দিয়েছিল। তারপর গাইটা কী দাস্ত ব্যামো! পশু ডাক্তার এলো। ওষুধপথ্য দিল। তবেই রক্ষা। এরপর থেকে ভালো রকম শিখেছে কচুরিপানার সঙ্গে সবুজ ঘাস মিশিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়।

মাঝরাতে সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্ন দেখে নয়নতারা খিদায় পাগল। রূপবানের ওলানে সাপ পেঁচিয়ে উঠেছে। দুধ খাচ্ছে চুকচুক করে।...আরো দেখে- স্বপ্নে কোন মুল্লুকে মালিকের খেতে নেপিয়ার ঘাস ফণফণিয়ে উঠেছে। তারা ঘাস সবুজ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ভ্যাদলা ঘাসের সবুজ আঁচল থরথর করে কাঁপছে।

সাহেব আলী রূপবানের চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছে। দেশি গাই গরু রূপবান ছিল টিংটিঙা। হাড্ডিগুলা গোনা যেত। সেই রূপবান আজ রূপ যৌবনের ভারে যেন চলতে পারে না মোটে। তেলচুকচুকা তার শরীর যেন ঝিলিক মারে। কাজলির বিদেশি রূপও মাটি করে দিয়েছে সে। খাঁটি সরষের তেলমাখা যেন গায়ে গতরে। সাহেব আলীর মন ভালো থাকলে গুনগুন করে,

‘চৈচৈ রে চাওন যায় না। চোখে ঝিলিক মারে।’

সবটুকু কৃতিত্ব তার একার। সিন্ধি গাই মুলতানি গাইগুলোর সঙ্গে ধানের ভুসি, কুড়া, মুসুরি, মুগ, মাষকলাই, মটরছোলা, খেসারি ডালের ভুসি খেতে দেয় রূপবানকেও। রূপবান এমন বাদশাহি খানা আগে চোখে দেখে নাই। সপ্তব্যঞ্জন ছাড়িয়ে যায়। কত নখরা কত নছল্লা। সাহেব আলীর বুকটা ভরে উঠে ঝিরিঝিরি আনন্দে। গোয়ালভরা গরুগুলোর আহার বিহারের পুরা ম্যানেজারি তার ওপর। কম কথা? মাইনক্যার মা গোয়াল ঝাটপাট দেয়। মাঝেমধ্যে তম্বি করে আলী। ভালো করে গোবর নিকানোর জন্যে চোনা ঝাট দেওয়ার জন্যে।

গোয়ালঘরের নোংরামি সাহেব আলীর মোটেও সহ্য হয় না।

আজ সাতসকালেই সাহেব আলী বায়না ধরেছে মালিকের কাছে।

‘এইবার শীতে ওলারস দেবোনে। খড় কুচাইয়্যা তারই মইধ্যে ওলারস মাখায়া দিলি গরু গবগবাইয়া খায় মালিক।’

‘এই ছেঁড়াডার খালি নতুন নতুন বায়নাক্কা।’

দাঁত খেলাল করতে করতে আমুদে মেজাজেই বলে,

‘তোর যত রঙের মক্কর। খাওয়াইস। গরুগুলোর মাতলা মাতলা লাগাবোনে দেহিসনি। দেহিস আবার নিজেও ওই রস টানিস না। পোতাজিয়ার নুরা পাগলা একবার ওলা রস খায়া কী কিত্তি। ওতা পুরা তাড়ির নিশা।’...

মালিক বয়সকালে যাত্রাপাগল ছিল। তখন ইয়ার বন্ধুদের বদআছরে অল্পবিস্তর মাল টানত। এখন গেলাস তো দূরের কথা, এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা হতে পারে না।

দু-তিন দিনের পচানো খেজুর রসের লেই ওলারস বিচালির ঝুরির সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়েছিল সাহেব আলী। চরচিতুলিয়ার মদনার কাছে জেনেছে, ওলারস গরুর স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। মদনাও জানেপ্রাণে ঘাসুড়ে। গোখাদ্য বিষয়েও তার অঢেল জ্ঞানগম্যি। ঘাস বিষয়ে মদনার অশেষ ব্যুৎপত্তি। গোখাদ্য পরিবেশনে অপার শিল্পকলা। মানিকে মানিক চেনে।

গত বর্ষার বড় বিলে গিয়েছিল দুই বন্ধু। তালগাছের ডোঙ্গায় করে গভীর পানি থেকে কেটে এনেছিল দাম জাতের ঘাস। কলাগাছের টুকরোগুলো আরো ক্ষুদ্রাকৃতি করতে করতে সাহেব গান ধরে, ‘খা গা মা তোর দালান ধুয়্যা। দালান দেখ্যা দিচু বিয়া’।...গাইতে গাইতে মনে হয় বাবলার ফল কয়টা পেড়ে আনবে। সুপারি বাগানের পূর্বকোণে বাবলার ফলগুলো পেকেছে। গরুর স্বাস্থ্যের জন্যে বাবলার ফল বড় উপকারী।

দোনা ভরে দুধ দোয়ায় বুড়া বরকত চাচা। দুই আঙুলে সরষের তেল লাগিয়ে কী কায়দায় যে সে ওলান টানে, মুহূর্তে ভরে উঠে দোনা ফেনা ফেনা সাদা উষ্ণ দুধের নহরে। ঘরের জন্যে কেজি দুই রেখে সব দুধ চলে যায় মিল্কভিটার কারখানায়। ঈদে শবেবরাতে দুধের ক্ষীর হয়। তা থেকে কিছুটা ভাগ পায় মাত্র সাহেব আলী। সাহেব আলী শামা ঘাসের পালাটা দুই হাতে নাড়ে চাড়ে। নরম মাখনের মতো। গন্ধটাও বড় মাতাল মাতাল।

‘মনে হয় তেল পেঁয়াজে এই ঘাসগুলোরে বউরে দিয়া রাঁধাই। কী মুলায়েম না জানি এর সোয়াদ! মানষে যদি কাঁচা ঘাস চাবায়া খাবার পারত তারে বড় ভালো হতো।’...

ক্ষুধাটা পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সুরাতন, ছেলে দুইটার হাড় জিরজিরে মুখগুলো ভেসে উঠে চোখে। একটা আউলা বাতাসে মনটা টনটন করতে থাকে। একটু আগে নজরে এসেছে নয়নতারার ঝোঁপ বরাবর কচুশাকগুলো বুড়া হয়ে গেছে, শক্ত শক্ত চেহারা হয়েছে।

‘আহারে! কচি কচুশাকগুলা ইলশার কাঁটা দিয়া খাবার খায়েশ আছিল মনে।’

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে পড়ে সাহেব আলীর বুকে।

‘দুর ছাই! ওবা কত ইচ্ছাইতো হবার পারে মানুষের। তাই বইল্যা কী সবডাই’...এলোমেলো ভাবনাগুলো গোত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মতো পাক খায়।

শামা ঘাসের ঝিরিঝিরি সবুজ ততক্ষণে চাড়ির মধ্যে গুছিয়ে দিয়েছে সাহেব আলী। কাজলি, নয়নতারা মুখ লাগিয়ে চ্যাকর চ্যাকর করে চাবাচ্ছে। সবুজ সাদা ফেনায় ভরে উঠেছে ওদের মুখ।

সাহেব আলীর দীর্ঘশ্বাসটি অতঃপর গড়াতে গড়াতে কোনো অচিন গর্তে যেন ডুবে যেতে থাকে।...

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close