এইচ আর তুহিন, যশোর

  ২৩ মে, ২০১৮

চৌগাছায় ২ কোটি টাকার কর্মসৃজন প্রকল্পে অনিয়ম

যশোরের চৌগাছায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পের প্রায় দুই কোটি টাকার কাজে নয়-ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে কিছুসংখ্যক শ্রমিক ছাড়া কোথাও এই প্রকল্পের কাজ দেখা যায়নি। এদিকে ৪০ দিনের প্রকল্পে ১৪ দিনের কাজ হলেও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে (পিআইও) বিল জমা দেওয়া হয়েছে ১৯ দিনের। এদিকে পিআইও অফিসকে ২০ শতাংশ টাকা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ও ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্টদের জন্য লেবার কোটা রাখায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ আছে, পিআইও অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অনিক বিশ্বাসের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এই লুটপাট হচ্ছে। চলতি মাসের ৮ মে থেকে এই প্রকল্প শুরু হয়েছে।

চৌগাছা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এ এস এম আবু আবদুল্লাহ বায়েজিদ ঝিকরগাছার সঙ্গে চৌগাছায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। জানতে চাইলে তিনি মুঠোফানে বলেন, ‘আপনার কাছে এ বিষয়ে প্রথম শুনলাম। আপনারা অভিযোগগুলো লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানান।’ সাংবাদিকরা কেন লিখিত অভিযোগ দেবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমার সামনে তাদের এনে প্রমাণ করেন। অভিযোগগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।’ তবে প্রকল্পতালিকা চাওয়ার পরও সাংবাদিকদের না দেওয়ার প্রশ্নে তিনি কোনো জবাব দেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১১ ইউনিয়নের ৯৯টি ওয়ার্ডের ৯৯টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যান, সদস্য, মহিলা সদস্য, ইউপি সচিব ও চৌকিদার-দফাদারদের জন্য একজন করে লেবারের কোটা রাখা হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানদের ব্যক্তিগত সহকারীদের নামেও কোনো কোনো ওয়ার্ডগুলোতে এক থেকে তিনজন শ্রমিক কোটা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বাস্তবায়নাধীন ৯৯টি প্রকল্পে মোট দুই হাজার ৩৮৪ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। তারা প্রতিটি ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে এসব শ্রমিক প্রকল্পের অধীন গ্রামীণ কাঁচা-আধাপাকা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কিন্তু বাস্তবে ১৫ শতাংশ শ্রমিকও কাজ করছেন না। সরেজমিনে বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে কাজ পরিদর্শনে গিয়ে পাওয়া যায় ভয়াবহ পুকুরচুরির কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং পিআইও অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কারণেই এমনটি হচ্ছে।

উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের আন্দারকোটা ওয়ার্ডে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও কয়েক দিনের পরিদর্শনে ছয়-সাতজনের বেশি শ্রমিক দেখা যায়নি। এমনকি কোনো কোনো দিন তারা কাজও করেন না। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাকির হোসেন ইউনিয়নের এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান। স্থানীয়ভাবে তিনি ইউপি চেয়ারম্যানের ‘ডানহাত’ বলে পরিচিত। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জাকির হোসেনে ব্যবহৃত মোবাইলে যোগাযোগ করে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। এসএমএস দিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি। গত বুধবার উপজেলার নারায়ণপুর ইউপির হাজরাখানা, পেটভরা, নারায়ণপুর, বাদেখানপুর, বুন্দেলীতলাসহ কয়েকটি গ্রামে ঘুরলে কোথাও কোনো শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধুলিয়ানি ইউপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওয়ার্ড সদস্য জানালেন, আমার ওয়ার্ডের প্রকল্প মূল্য ধরা হয়েছে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা। ওয়ার্ডটির প্রকল্পে ২১ জন লেবার কাজ করার কথা। কাজ করছেন ১৬ জন। বাকি পাঁচ জনের একটি ইউপি চেয়ারম্যান, একটি আমি, একটি ইউপি সচিব, একটি ইউনিয়ন অফিস, একটি চৌকিদার-দফাদারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এই পাঁচজন কাজ না করলেও টাকা উঠে যাবে। গত তিন দিনে তাদের টাকা উঠে গেছে বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।

তিনি আক্ষেপ করে বললেন, আমার নামে একটি লেবার বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যাতে থেকে ৪০ দিনে আমার আসবে আট হাজার টাকা। এখন উপজেলা পিআইও অফিসের ২০ শতাংশ হারে প্রায় ৬০ হাজার টাকা আমি কোথায় থেকে দেব বলুন?

পিআইও অফিসের টাকা কিভাবে দেওয়া হবে জবাব পাওয়া গেল স্বরুপদাহ ইউনিয়নের অন্য একজন ইউপি সদস্যের কাছ থেকে। তিনি বললেন, শেষের কয়েক দিন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। অফিস কাজ বন্ধ হয়ে গেছে বলা হবে। পরে বিল তুলে নেওয়া হবে। অবশ্য একটি সূত্র দাবি করেছে, সম্প্রতি ধান কাটার মৌসুম। এ জন্য কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে এমন ঘোষণা দিয়ে কাজ বন্ধ করে পরে বিল তুলে নেওয়া হয়েছে।

উপজেলার এক ইউপি চেয়ারম্যান স্বীকার করেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান হয়েই যেন বিপদে পড়েছি। উপজেলা থেকে কোনো প্রকল্প নিতে গেলেই কমপক্ষে ২০ শতাংশ টাকা দিতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বর, চৌকিদার-দফাদার আছে। ইউপি সবিচরা টাকা ছাড়া ফাইলে স্বাক্ষর করতে চান না। অন্যদিকে জনগণকে কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে বলা হয়। আমরা কোথায় যাব বলুন তো?’

এদিকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোর প্রকল্প সাইডে সাইনবোর্ড টানানোর নামে ব্যবসার অভিযাগে পিআইও অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অনিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। সাইনবোর্ড তৈরির জন্য প্রকল্প সাইড সংশ্লিষ্ট মেম্বরদের নিকট থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নিয়েছেন। অথচ, চৌগাছার একটি আর্টের দোকান থেকে মাত্র ৬০০ টাকায় সাইনবোর্ড তৈরি করে দিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। তবে বেশির ভাগ প্রকল্প সাইডেই সাইনবোর্ড টানানো হয়নি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এ এস এম আবু আবদুল্লাহ বায়েজিদের অনুপস্থিতিতে অফিসের উপ-সহকারী অনিক বিশ্বাসই এই পুকুরচুরির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে পিআইও অফিস এবং জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানা গেছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইও অফিসের উপ-সহকারী অনিক বিশ্বাস অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার কাছে প্রকল্প তালিকা দেওয়ার কথা বললে তিনি ইউএনও দোহাই দেন। প্রকল্প সাইডে কোনো সাইনবোর্ড না থাকার কথা বললে, ‘আমরা তো পরিদর্শনের সময়ে সাইনবোর্ড পেয়েছি।’ তবে কোনো কোন সাইডে সাইনবোর্ড আছে তা বলতে পারেন নি তিনি। তবে কোনো বিল এখনো অফিসে জমা হয়নি বলে দাবি করেন এই উপ-সহকারী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist