ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান

  ১৪ মে, ২০২২

আদরি

বর্ষাকাল। ভোরবেলা। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। ভোরের বৃষ্টি ঘুম বাড়ায়। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে। আমি জেগে গেলাম। বৃষ্টির রিমঝিম নূপুরধ্বনি জাগিয়ে দিল আমাকে। কী এক অজানা ছন্দে দুলছে আমার মন। ভোরের পাখিরা করছে কিচিরমিচির। বৃষ্টির ছন্দ আর পাখির গানে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ইচ্ছে হচ্ছে কবিতা লিখি,

বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর

টিনের ঘরের চালে

বর্ষাকালে ফুল ফুটেছে

কদমগাছের ডালে।

কবিতা লিখতে বসে গেলাম। বৃষ্টির ছন্দে কবিতার সাথে পায়চারি করছে মন।

পাখির মতোই সুরেলা কণ্ঠে হঠাৎ একটা ছোট্ট মেয়ের ডাক, আন্টি! আন্টি! ও আন্টি...! গেটটা খুলেন আন্টি...!

আমি বুঝতে পারলাম পাড়ার কোনো ছোট বাচ্চা আমার স্ত্রীকে ডাকছে।

গেট খুলে দিলাম। সাত-আট বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। আমাকে দেখেই নরম কণ্ঠে সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম আংকেল। আপনি ডাক্তার আংকেল না?’ ওলাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, আমি ডাক্তার আংকেল। তুমি আমাকে চেনো নাকি? ‘জি আংকেল। আমি আপনাকে ভালো করেই চিনি। আমি তো প্রায়ই আম্মুর জন্য আপনার ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনি।’ তাই? ‘জি আংকেল। আপনি আমাকে দেখেননি?’ হ্যাঁ, দেখেছি মনে হচ্ছে। তোমার নাম? কোন বাড়ি তোমাদের? ‘আমার নাম আদরি। আমরা ওই পাঁচতলা বাড়ির তিনতলায় থাকি।’ বেশ আদরের নাম তো! তোমার আব্বুর নাম? ‘আব্বুর নাম সানু মণ্ডল। আমি রাজুর বড়বোন।’ রাজু কে? ‘ওমা! আপনি রাজুকে চেনেন না? রাজু তো প্রতিদিন আপনাদের বাসায় আসে। আপনার মোবাইলে গেম খেলে। আপনারা ওকে খুব আদর করেন।’ ও আচ্ছা। ওই মোটা রাজুর বড়বোন তুমি? ‘জি আংকেল। আমার আম্মুও তো প্রতিদিন আন্টির কাছে আসেন। আপনি দেখেননি বুঝি?’ হ্যাঁ দেখেছি। তোমার আম্মু তো খুব ভালো মানুষ। ‘জি আংকেল। এ কথা আমার আব্বুও বলে।’ কিন্তু তোমাকে তো আমাদের বাড়িতে আগে কখনো দেখিনি! ‘ওমা! আমাকে আপনাদের বাড়িতে দেখবেন কী করে? আম্মু তো আমাকে কারও বাড়িতে বেড়াতে দেন না। কোনো কিছু কিনতে হলে দোকানে পাঠান। শুধু কাজে পাঠান।’ ও আচ্ছা। তো আজ এত সকালে আমাদের বাড়িতে কীসের জন্য এসেছো? ‘আম্মু কচুর লতি তুলতে পাঠিয়েছেন। আপনাদের খেতে নাকি কচুর লতি আছে?’ হ্যাঁ আছে। তুমি নিজে কচুর লতি তুলবে? ‘হ্যাঁ আংকেল আমাকেই তুলতে হবে।’

আমি আদরিকে নিয়ে ঘরের ভেতর হয়ে পেছনের দরজা খুলে দিয়ে কচুখেত দেখালাম। কিন্তু কচুখেতে নামতে বারণ করলাম। খেতে বেশ পানি জমে গেছে। কচুখেতের লকলকে সবুজ ঘাসের ডগায় লৌ-পিপাসু জোঁকেরা কিলবিল করছে। ভয়ে আমি মেয়েটিকে কচুখেতে নামতে নিষেধ করে বললাম, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই আদরি। সত্যি কথা বলবে তো? ‘কী কথা আংকেল?’ বলো সত্যি বলবে? ‘ওমা! আমি আপনাকে মিথ্যে বলব কেন? আপনি আমার বাবার মতো।’ তুমি কি সত্যি রাজুর বড়বোন?

মেয়েটি মাথা নিচু করে টুপ! আমি আবার বললাম, বলো। তুমি কি সত্যি সত্যি রাজুর বোন?

মেয়েটির চোখের কোণে জল এলো! কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ আংকেল আমি সত্যি রাজুর বড়বোন। আপনার বিশ্বাস হয় না?’ না। আমার বিশ্বাস হয় না। ‘কেন আংকেল?’ রাজু এত ময়লা জামা পরে না। তুমি রাজুর বোন হলে তোমাকে তোমার আম্মু কচুর লতি তুলতে পাঠাতে পারেন না।

মেয়েটির দুগাল বেয়ে অশ্রু নেমে এলো! কান্না সামলানোর চেষ্টা করে থেমে থেমে বলল, আংকেল, ‘আমি আপনাকে একটা কথা বলব। বলুন, আপনি কাউকে বলবেন না। এমনকি আন্টিকেও না।’ না। বলব না। তোমার আন্টিকেও বলব না। ‘আংকেল, আমি রাজুর সৎবোন। রাজুর মা আমার আসল মা নন। আম্মু ওনার নিজের ছেলেকে যেভাবে আদর করেন সেভাবে আমাকে করেন না। আমাকে বাসার কাজের মেয়ের মতো দেখেন। বাসার সব কাজ আমাকে দিয়ে করান।’ তোমার আসল মা কোথায়? ‘মা নানার বাড়িতে থাকেন।’ তোমার আব্বু তোমাকে আদর করেন না? ‘জানি না আংকেল। আব্বু আমার ব্যাপারে বাসায় চুপ থাকে।’ তুমি কি স্কুলে যাও? ‘না।’ কেন? ‘আম্মু আমাকে স্কুলে যেতে দেন না। আমার স্কুলের ম্যাডামরা সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন।’ কেন? ‘আমি কেন স্কুলে যাচ্ছি না সেটা জানার জন্য।’ কী জানলেন তারা? ‘আম্মু ম্যাডামের কাছে বলেছেন, আমি নাকি অসুস্থ! সুস্থ হলে স্কুলে পাঠাবেন।’ তোমার আম্মু মিথ্যে বললেন কেন? ‘আম্মু চান না আমি পড়াশোনা করি।’ তুমি কি পড়াশোনা করতে চাও? ‘স্কুলের ম্যাডামরা আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমি নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো। স্কুলের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। স্কুল আমার খুব প্রিয়। আমি রেগুলার স্কুলে যেতে চাই। লেখাপড়া করতে আমার খুব ভালো লাগে আংকেল।’ রাজু কি স্কুলে যায়? ‘রাজুর কোনো কিছুর অভাব নেই। সে যা চায় তা পায়। কিন্তু সে স্কুলে যেতে চায় না। স্কুলে গেলে সবার সঙ্গে দুষ্টুমি করে। ম্যাডামদের মোবাইল নিয়ে টানাটানি করে। তাই ওকে স্কুলের কেউ পছন্দ করে না। আম্মু তাকে কোনো শাসনও করেন না।’ বুঝেছি! ভেরি সেড! (চলবে)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close