মো. জাহাঙ্গীর আলম

  ০৪ অক্টোবর, ২০২২

টেকসই উন্নয়নে নারী কৃষি উদ্যোক্তা

আমাদের দেশের অর্থনীতির অবকাঠামো পরিবর্তনের কারণে শিল্প ও সেবা খাতের অনুপাত কৃষি খাতের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো পুরোটা কৃষিনির্ভর, যার অনেকটাই নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের হাতে ধরে চলছে। দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি ও কৃষিতে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান- এ দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই কৃষি যেমন নারীর হাতে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও নারীর হাতে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীর অংশগ্রহণ যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক।

স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষিত হবে। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। এমডিজি বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তী পর্যায়ের জন্য নেওয়া পরিকল্পনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নেও সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টির পথে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০২১ অনুযায়ী এসডিজি অর্জনে বিশ্বের যে তিনটি দেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে, তার মধ্যে সবার ওপরে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারির কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। কারোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি সচল থাকার কারণেই উৎপাদন ব্যবস্থার অবস্থান অনেকটা ভালো রয়েছে, আর এর কারণ হলো কৃষি খাতে নারী শ্রমিক ও নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কৃষি খাতের পরোক্ষ অবদান রয়েছে। দেশের মোট শ্রমজীবীর প্রায় ৪১ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষি খাতের উন্নয়নের সঙ্গে দেশের বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। আর অন্যতম অংশীদার এ খাতের নারী শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি সচল রাখতে এ খাতের নারীরা ব্যাপক অবদান রেখেছেন। টেকসই উন্নয়নের ধারা তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর ক্ষমতায়ন, পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে অংশগ্রহণ এবং দারিদ্র্যমোচন অব্যাহত রাখতে এবং নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের অবদানকে ধরে রাখতে সরকার প্রণীত বিভিন্ন নীতি, আইন, বিধিবিধানসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের নানা কর্মসূচি ও কার্যক্রম লক্ষ্য পূরণের জন্য একই সঙ্গে চলমান রয়েছে।

গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে কয়েক কোটি শ্রমশক্তি নতুন যোগ হয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশিই নারী। আর এই নারীর বেশির ভাগই কৃষি খাতের নারী শ্রমিক ও উদ্যোক্তা। নতুন এসব নারী উদ্যোক্তা মূলত গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদনসহ ধান, পাট ও গম চাষাবাদে নিয়োজিত রয়েছে। মূলত গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে গতি আনতে নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের ভূমিকাই মুখ্য।

স্বাধীনতার পরে সত্তর ও আশির দশকে গ্রামীণ নারীরা বাড়ির বাইরে গিয়ে কৃষি কাজ অংশগ্রহণ কমই করত। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে নারীরা কৃষি কাজে বীজ সংরক্ষণ, জমি প্রস্তুত, চারা রোপণ, ফসল কাটা, ফসল ঘরে তোলাসহ সব কাজের সঙ্গে যুক্ত। তবে অনেক আগে থেকে বাড়ির গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনের সঙ্গে নারীরা জড়িত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে নারীরা বাণিজ্যিকভাবে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে ব্যাপকভাবে জড়িত। মাছ চাষ, মৌমাছি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন ও ফলমূল চাষ থেকে শুরু করে বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি নানা জাতের সবজি উৎপাদনের বিশাল কর্মযজ্ঞে আজ নারীরা সমান অংশীদার।

পরিসংখ্যান বলছে, বৃহত্তর কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। গত ৫০ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতকের ঘর থেকে কোটিতে পৌঁছে গেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, কৃষিতে এখন নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

দেশে মোট শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নারী। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের অধিকাংশ কৃষি কাজে নিয়োজিত। ফসলের প্রাক-বপন থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণন পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় নারী এককভাবেই করে। বাড়ির বাইরে ফসল ও সবজি চাষ, মসলা উৎপাদন, শুঁটকি ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ, মাছ ধরার জাল তৈরি ও মেরামত, পোনা উৎপাদন, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালনের কাজও নারীরা আজ প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। সামাজিক বনায়নের কাজও হয় নারীর হাত দিয়ে। নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনে ডাইভারসিফিকেশন (বৈচিত্র্য) বেড়েছে। নারীরা বসতবাড়ির আঙিনায় বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি উন্নত ফলনশীল শাক-সবজি ও ফলমূলসহ নানা জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন করছে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, কৃষি কাজ বলতে এখন আর শুধু মাঠে ফসল চাষাবাদকেই বোঝায় না, বরং বোঝানো হয় শস্য উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, শাকসবজি, ফলমূল চাষ ও বনায়ন বা বাড়ির আশপাশে এমনকি বাড়ির ছাদেও গাছ লাগানো প্রভৃতি। এ বিবেচনায় এ সময় কৃষিতে পুরুষের তুলনায় নারী অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পুরুষরা মূলত শহরে পড়াশোনা, চাকরি ও ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁঁকে যাওয়া গ্রামীণ কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। পুরুষদের মধ্যে যতসংখ্যক পুরুষ কৃষিকাজে যুক্ত, তার চেয়ে নারী কর্মজীবীদের মধ্যে অনেক বেশিসংখ্যক কৃষিকাজে যুক্ত। কৃষি উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের। উদ্যোক্তা হিসেবে আর্থিক সংকট, ঋণ না পাওয়া, ভূমির মালিকানায় সমণ্ডঅধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ব্যবস্থার অভাব এবং গ্রামীণ হাটবাজারে প্রবেশসহ যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার করণে নারীরা কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত হয় না। বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এনজিও) থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণের কারণে তাদের নানা ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি ঋণ ব্যবস্থাকে আরো সহজীকরণসহ পর্যাপ্ত করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণনের জন্য নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ বাজার স্থাপনসহ অনলাইনে বাজার বিপণন ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারাও যাতে অনলাইন বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের তৈরিকৃত পণ্য বাজারজাত করতে পারেন, সেজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে।

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি ও কৃষকরাই বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। সরকার গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন দলিল, বিশেষ করে রূপকল্প-২০২১, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি), সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাস্তবায়নের কৌশল অনুসরণে করে ‘জাতীয় কৃষি নীতি, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কৃষি খাতকে টেকসই ও সমৃদ্ধ করতে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কৃষিবান্ধব উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও দেশের কৃষি খাতকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর পাশাপাশি সরকারি চাকরি ও কৃষিক্ষেত্রে আরো অধিক সংখ্যক নারী কৃষক এবং কৃষি শ্রমশক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কৃষি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নারীর অবদান রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাই কৃষি-সংক্রান্ত অর্থ উপার্জন কর্মকাণ্ডে নারীকে অর্থবহভাবে সম্পৃক্ত করে এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকার নারীর ক্ষমতায়ন; উৎপাদন ও বিপণনে অংশগ্রহণ এবং আয়ের সুযোগ তৈরির ওপর আরো অধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

যেকোনো দেশের নারীদের বাদ দিয়ে, অবহেলা করে, বা দূরে রেখে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনোই সফল হবে না। তাই সারা বিশ্ব আজ অনুধাবন করতে পেরেছে, নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন ছাড়া সমগ্র বিশ্বের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাই এসডিজি অর্জনে নারীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। সেই বিবেচনায় এ দেশের জন্য উন্নয়ন কার্মকাণ্ড তথা কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ আরো বেশি জরুরি। আগের তুলনায় দেশে নারী-পুরুষের মধ্যকার ব্যবধান বা লিঙ্গবৈষম্য কমে আসছে। আয় উপার্জনক্ষম কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীর অংশগ্রহণ বাড়ায় নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য কমে আসছে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও কৃষিতে নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যাবশক। (পিআইডি নিবন্ধ)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close