১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধেও তেমনি নারীর রয়েছে বীরত্বপূর্ণ অবদান। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও নারীদের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধে কোনো দল, গ্রুপ বা পক্ষের একক অবদান আছে; এটা কখনোই বলা কাম্য নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর অবদান বিশদ আলোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। নারী তার সব সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদানকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ক্ষেত্রে নিপীড়নের অগ্নিসাক্ষী বা লাঞ্ছিতণ্ডনিপীড়িত মাণ্ডবোন নামেই প্রচার হয়েছে বেশি। আর এ কারণেই সম্ভবত রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্কুলণ্ডকলেজণ্ডভার্সিটির ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষিকারা মঞ্চে উঠেই অনর্গল বলতে থাকেন, ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মাণ্ডবোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।

যুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা আমাদের অনেক বড় সহায় শক্তি ছিল এ কথা অনেকেই ভুলে গেছেন। পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য এ দেশের নারীণ্ডপুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সব শ্রেণিপেশার মানুষ সম্মিলিতভাব মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

নারীরা কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়েছেন আবার কখনো যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। দুঃসাহসী নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন, সেভাবে কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। বহু নারী আছেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেবা করেছেন, অনাহারিণ্ডঅর্ধাহারি ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনো মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনো বোনের মতো। নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন।

আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধ।

উল্লিখিত কর্মকাণ্ডের যেকোনো একটি বাধাগ্রস্ত হলে যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ কথা ঠিক, এসব কাজে যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন, তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেকোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সেক্ষেত্রে নারীদের ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে বেশি।

এসব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। মুক্তিযুদ্ধে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য।

প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতি রানী দাস পুরকায়স্থ, শুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরো অনেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এগুলো প্রচারণায় এসেছে। আরো কত কাহিনি আছে, যা রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। ‘মুক্তির গান’ সিনেমাটা দেখলে আরো অনেক বিষয় স্পষ্ট হওয়া যায়। ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন কলকাতায় বসে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে গানের টিম পাঠিয়ে উদ্দীপ্ত করতেন যোদ্ধাদের। এ কাহিনি কজনইবা জানে।

নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। তাছাড়া যুদ্ধ চলাকালে অনেক নারী কবি, লেখক, সাংবাদিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন দেশ স্বাধীন করার কাজে। তাদের লেখায় ও শিল্পীদের গানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।

শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’, কল্যাণী ঘোষের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ এ রকম অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধিণ্ডবিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক বাঙালি নারী। তাদের মধ্যে কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, রওশন আরা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব নারী সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং। যেমন সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং, অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনেক নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন।

প্রাণ বিষণ্ন হতে পারে এ কথা জেনেও যেসব মাতা, ভগিনীণ্ডকন্যারা প্রাণপ্রিয় স্বামী, ছেলে, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, তাদের এ মহানুভবতার উৎসও অবশ্যই দেশপ্রেম। এ ক্ষেত্রে শেখ ফজিলাতুন নেছার নাম সর্বাগ্রে। এ ছাড়া বেগম সুফিয়া কামালসহ হাজারো নাম না জানা নারী যোদ্ধা ছিলেন। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। পিরোজপুরের ভাগিরথীর আত্মদান কোন গেরিলা অপারেশনের চেয়ে কম? পুরুষের পোশাকে এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল, আলেয়া বেগম।

এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথাও বলা দরকার। শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম বা শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মাণ্ডই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে মোট ৬৭৬ বীর যোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন নারীও রয়েছেন। একজন হলেন ডা. সেতারা বেগম এবং অন্যজন তারামন বিবি; যাদের ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব দেওয়া হয়। বাঙালির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাই তাদের এই অবদানকে যথাযথভাবে সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

"