গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

ইভিএম মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প

প্রস্তাবে ‘না’, বাঁচল ১০ হাজার কোটি টাকা

সরকারের কাছে আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ পায়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রাণসংহারী করোনাভাইরাসসহ বিশ্বময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এটিসহ ২৭২টি প্রকল্পকে অদরকারি চিহ্নিত করে এগুলোর মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে ভোটযন্ত্রগুলো ধ্বংস বা পুড়িয়ে ফেলতে চাচ্ছে ইসি। চলতি সপ্তাহে কমিশনের অনুমতির জন্য এ সংক্রান্ত নথি বা প্রস্তাব উত্থাপন করবে কমিশন সচিবালয়।

এর আগেও ইভিএম মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা চেয়ে প্রস্তাব দিলে তাতে সম্মতি দেয়নি সরকার। এতে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ইসির শুভবুদ্ধির উদয় হোক। কারণ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এই যন্ত্রে ভোট আয়োজন না করতে শুরু থেকেই বিরোধিতা করলেও কোমর বেঁধে নেমেছিল কমিশন। আলটিমেটলি রেজাল্ট ‘জিরো’। তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও ব্যর্থতা স্বীকার না করে উল্টো কম দামে ইভিএম কেনার চিন্তা করছে কমিশন। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর কম দামে ইভিএম কেনার ইঙ্গিত দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তবে কেউ বলেছেন কমিশনারের বক্তব্য ভাসাভাসা। খবর ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানতে চাইলে গত ৬ এপ্রিল ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ আসছে জুনে শেষ হবে। আমরা সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সরকারের কাছে ৬ মাস কিংবা এক বছর সময় বৃদ্ধির প্রস্তাবের জন্য। কিন্তু প্রস্তাব পাঠানোর আগেই সরকার থেকে জানানো হয়েছে এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে না। শুধু এই প্রকল্প না, দেশের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৭২টি প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটাই; নতুন করে মেয়াদ বৃদ্ধিতে সম্মতি নেই সরকারের। বিদ্যমান ইভিএম সংরক্ষণে প্রকল্পে অর্থ আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘না’। তাহলে ইভিএমগুলো কি ধ্বংস করবেন কি না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, এগুলোর জন্যও সরকারের অনুমতি লাগবে। দেখা যাক, অনুমতি চাওয়া লাগতে পারে।

আর গত মঙ্গলবার ইভিএমের সর্বশেষ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ইভিএম ধ্বংসের জন্য সরকারের কাছে অনুমতি নেওয়ার আগে কমিশনের সম্মতির জন্য নথি উৎত্থাপন করা হবে। কমিশনের সম্মতি পেলে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক পত্র পাঠানো হবে। চলমান উপজেলা নির্বাচনের পর ইভিএম যুগের সমাপ্তি ঘটতে পারে। আগামীতে ইভিএম পুনরায় চালুর বিষয়ে কমিশনে কোনো আলোচনা আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘না’।

তবে বুয়েটের ইভিএম যন্ত্রের উদ্ভাবক অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির প্রতিদিনের সংবাদের কাছে প্রথমে মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে শুধু বলেন, আমাদের ইভিএম ছিল উন্নত। সেটা বাদ দিয়ে বিএমটিএফের দিকে ঝুঁকল কমিশন। এই ইভিএম এত অল্প সময়ে অকেজো হওয়ার পথে যা দুঃখজনক। শুধু রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ যাচাই করে এক-এগারোর ড. শামসুল হুদা কমিশন ভোটব্যবস্থায় প্রথম ইভিএম যোগ করেন। কিন্তু সীমিত পরিসরে করে মেয়াদের পাঁচ বছর পূর্ণ করে অবসরে যান। নতুন সাংবিধানিক পদে আসেন কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন। এই কমিশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেন। ইভিএমে বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে পুরো প্রকল্পটি বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই কমিশনের সময়ে স্টকে থাকা ১১০০ ইভিএম শেষ পর্যন্ত ধবংস করার মাধ্যমে জাতিকে দায়মুক্তি দেয় কাজী রকিব কমিশন। ফলে সরকারের বড় অঙ্কের অর্থের অপচয় ঘটে। পরবর্তীতে বুয়েটের উন্নত প্রযুক্তির এই ইভিএম বাদে নতুন করে বিএমটিএফের সহায়তায় ইভিএম প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এটি শুরু হয় কে এম নুরুল হুদা কমিশনের সময়ে। প্রতিটি ইভিএম ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করে দেড় লাখ এই যন্ত্রের পেছনে খরচ হয় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন আরো দুই লাখ ইভিএম কিনতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অথনৈতিক মন্দার কথা বিবেচনায় সরকার ইসির এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। এতে সরকারের গচ্চা আড়াই হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল।

গত ২১ মার্চ ইসির ২৯তম কমিশন সভা পরবর্তী ২৫ মার্চ আরেকটি সভার কার্যপত্রে তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ইভিএম নিয়ে নানা অব্যবস্থাপনা। সেখানে বলা হয়, এ প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের অপরিশোধিত বিল পরিশোধ, ক্রয়কৃত রেক ও ইভিএম সেটসহ প্রকল্পের সব মালামাল, সম্পদ হস্তান্তর, ইভিএম রেক সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউস ভাড়া বাবদ বিএমটিএফের দাবি করা অর্থের নিষ্পতীকরণ, ডেটা কাস্টমাইজেশন, কার্ড প্রিন্ট মেশিন অপারেশন এবং নির্বাচনের সময় ইভিএমের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কাজ সম্পাদনের তাগিদ দেওয়া হয়। সেখানে প্রকল্পের বকেয়া বিল পরিশোধ, বিএমটিএফের ওয়্যারহাউসে সংরক্ষিত ১ লাখ ১ হাজার ৩৫টি ইভিএমসেট ও ১১ হাজার ৩০৬টি ইভিএম রেক বিএমটিএফ থেকে এবং নির্বাচন ভবনের বেজমেন্ট-১ এ রক্ষিত ৬৯৮টি ইভিএম সেট সচিবালয় কর্তৃক গ্রহণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং প্রকল্পের অন্য মালামাল ও সম্পদ হস্তান্তরের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

এছাড়া প্রকল্পের ডিপিপি ও আরডিপিপি অনুযায়ী বিদ্যমান ইভিএমের স্থায়িত্ব ১০ বছর বিবেচনায় এগুলোর যাচাই-বাছাই করার জন্য অব্যয়িত অর্থ খরচ করে মেরামতযোগ্য করার প্রস্তাব রাখা হয়। বর্তমান মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত এ প্রকল্পের অধীনে উদ্ধৃত্ত অর্থের অঙ্ক ছিল মাত্র ১১ লাখ ৫৭৬ হাজার ২২৪ টাকা, এ টাকা দিয়ে ১০০টি ইভিএমের বেশি মেরামত করা সম্ভব না। এজন্য সরকারের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা চেয়েছিল ইসি তবে সারা মেলেনি।

এ কার্যপত্রে প্রকল্প বিষয়ে প্রস্তাব ছিল উপজেলা নির্বাচনের পর ভবিষ্যতে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত না হলে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ ৬ মাস থেকে ১২ মাস বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সরকার কোনো ধরনের প্রলোভনে না পড়ে প্রকল্পের মেয়াদ বৃৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে যাওয়ার আগেই নাকচ করেন। এর ফলে নতুন করে ইভিএমগুলো ধ্বংসের জন্য অনুমতি চাইবে কমিশন। এ প্রক্রিয়ায় গেলে সরকারের আপতত গচ্চা যাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ইভিএম মেরামত এবং নতুন ইভিএম কেনার জন্য প্রস্তাবে সম্মতি দিলে সরকারের গচ্চা দাঁড়াত ১২ হাজার কোটি টাকার ওপরে।

এ পরিস্থিতির মধ্যে কম দামে ইভিএম কেনার স্বপ্ন দেখালেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। এতে ক্ষুব্ধ অর্থনীতিবিদ আধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, ইভিএম একটি রাজনীতিতে বিতর্কিত যন্ত্র। এ নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু কারো কথায় কর্ণপাত না করে এ যন্ত্রের দিকে ঝোঁকে নির্বাচন কমিশন। এতে সরকারের গচ্চা আড়াই হাজার কোটি টাকা হলেও বিভিন্ন সময়ে দাবি প্রস্তাবে সরকার সম্মতি না দেওয়ায় সাশ্রয় অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close