নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

অটোরিকশা প্রতিস্থাপন

১১৩ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য

সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৬ বছরে ১১৩ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ’র চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আরো কিছু মালিক, নেতা ও দালালরা এই বাণিজ্য করেছে। এর মধ্যে শুধু অটোরিকশায় সিএনজি প্রতিস্থাপন করতেই ঘুষ নেওয়া হয় প্রায় ১০৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে অভিযোগ যাওয়ার পর সংস্থাটি অনুসন্ধানে নেমেছে। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন গতকাল রবিবার দ্বিতীয় বারের মতো দুদকে এ অভিযোগ পেশ করেন। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর তিনি দুদকে অভিযোগ পেশ করেছিলেন। দুদক এই অভিযোগ ধরে মাঠে যাছাই-বাছাই করছে বলে জানা গেছে।

মোহাম্মদ হানিফ দুদক চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার আয়ুষ্কাল ধরা হয় ১৫ বছর। ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ঢাকায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার সিএনজির নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এরপর মেয়াদোত্তীর্ণ সব অটোরিকশা প্রতিস্থাপনের জন্য ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর জন্য তখন সরকারি ফি ছিল ১২ হাজার ১০০ টাকা। এসব অটোরিকশার মালিকদের নতুন করে আবার নিবন্ধন নম্বর দিতে করা হয় ঘুষ বাণিজ্য। সাড়ে ১২ হাজার অটোরিকশার স্ক্র্যাপ বাবদ ঘুষ দিতে হয় সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে নেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। রেজিস্ট্রেশন বাবদ ২৫ হাজার করে ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, গাড়ির ভগ্নাংশ বিক্রি বাবদ সাড়ে ১২ কোটি এবং সিএনজি রিকশা ৫ বছরের মেয়াদ বৃদ্ধি বাবদ ঘুষ নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। ১১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বাণিজ্য করে চক্রটি। ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী-মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু ও সদস্য সচিব এ টি এম নাজমুল হাসানসহ একটি চক্র প্রতিস্থাপন কাজে জড়িত ছিল। তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা দালাল হিসেবে নিয়োজিত ছিল। এই দালাল চক্র গাড়িভাঙা ও নিবন্ধনের জন্য ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে পরিষদের ওই নেতাদের হাতে তুলে দিত বলে অভিযোগ রয়েছে। তারাই বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অংশ লেনদেন করতেন। ঘুষের এই টাকা বিআরটিএ কর্মকর্তা, মালিক সমিতির নেতা ও দালালদের মধ্যে ভাগবটোয়ারা হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে।

দুদকের কাছে বিআরটিএ এর একটি দালাল চক্রের তালিকাও দিয়েছে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। তাতে দেখা যায়, বিআরটিএ’র সাবেক ৮ জন আনসার সদস্য; মিরপুর এলাকার ৪ জনসহ ২৪ জন রয়েছে এই চক্রে। রাজধানীর বাড্ডা, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বিআরটিএ’র কর্মকর্তারাও।

সূত্র জানায়, বিআরটিএ’র ঘুষ বাণিজ্যের সব টাকা মেট্রো সার্কেল-১ হিসাবরক্ষক খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন তদারকি করেন। সম্প্রতি খান মো. রুহুল আমিন হিসাবরক্ষক থেকে এও হয়েছেন। হিসাবরক্ষক থাকাকালে নতুন পুরাতন লাইসেন্স, মালিকানা বদলি ও রোড পারমিট খাতে ঘুষ নিতেন তিনি। যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

২০১৬-১৭ সালে ঢাকা মহানগরীর সিএনজি-অটোরিকশার মেয়াদ ১৫ থেকে ২০ বছর করার জন্য ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ বরাবর আবেদন করেন এবং মালিকদের সিএনজি অটোরিকশার মেয়াদ ৫ বছর বৃদ্ধি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাড়ে ১২ হাজার সিএনজি-অটোরিকশা মালিকদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন। তার কাছে অটোরিকশা মালিকদের পাঠানোর একটি চ্যানেলও রয়েছে। প্রায় ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান ও বিআরটিএ’র আনসার সদস্য রয়েছে সেই তালিকায়।

রাজধানীর উত্তর বাড্ডার সৌরভ অটো সেন্টারের দেবাশিষ বিশ্বাস, একই এলাকার সিএনজি অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক এনামুল হক ডালিম, রামপুরা ওয়াপদা রোড এলাকার সিএনজি অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক মনির হোসেন, মেরুল বাড্ডা এলাকার মো. জালাল, শাহাজাহানপুর এলাকার খন্দকার মহিন রণি, মগবাজার চৌরাস্তার দ্বীন ইসলাম মোটর্সের দ্বীন ইসলাম, মগবাজার রেলগেট এলাকার দিগন্ত অটো সেন্টারের মালিক কমল কুমার রায় গৌতম, একই এলাকার সুলতান অটো সেন্টারের মালিক হাজী সুলতান উদ্দিন ও বাংলাদেশ অটো সেন্টারের মালিক সুভাষ, মীর হাজারীবাগ এলাকার সিএনজি অটোরিকশা গ্যারেজ মালিক দেলোয়ার, মিরপুর এলাকার কাদের, জহির, লুৎফর, আনোয়ার, আনসার রুবেলসহ বিআরটিএ’র সাবেক আনসার জিয়া, রফিক, শহিদুল, ফরিদ ও সেলিম তাতে জড়িত ছিল।

এছাড়াও এই চক্রে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু, সদস্য সচিব এ টি এম নাজমুল হাসান, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক (মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি) মো. ফরিদুল ইসলাম খসরু, যুগ্ম আহ্বায়ক (ঐক্য পরিষদ) ও সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল খালেক মজনু, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিটি অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি মোতালেব হোসেন, কার্যকরী সদস্য দেবাশিষ বিশ্বাস, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সভাপতি হারুন উর রশিদ চক্র স্ক্র্যাপকৃত প্রতি সিএনজি অটোরিকশার প্রতিটি ১০ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছে এবং রেজিস্ট্রেশন ও স্ক্র্যাপের ব্যাপারে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের ঘনিষ্ঠ সহচরদের নিয়োগ দিয়েছে। এই দালালচক্র গাড়ি স্ক্র্যাপ ও রেজিস্ট্রেশনের ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতাদের হাতে তুলে দিতেন। মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদ নেতাদের একটি অংশ বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তাদের মাঝে লেনদেন করতেন। বাকি অর্থ দালালসহ তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা করে নিতেন।

গত ২৮ জানুয়ারি দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী মুসা জেবিন ও মো. মাহমুদুল হাসান ভূঁইয়ার সমন্বয়ে একটি টিম বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে। গ্রাহক সেজে দুদকের এনফোর্সমেন্টের টিমের অভিযানে হাতেনাতে বাবু রায় নামে একজন দালালকে আটক করে দুদক। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সঙ্গে থাকা ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই দালালকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রকৃত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অভিযুক্তরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই আমি আবার অভিযোগপত্র দিয়েছি। ঘুষ বাণিজ্য শুধু খুদে দালালদের দিয়ে পরিচালনা করা হয় না, প্রভাবশালী দালালরা ঘরে বসে তাদের উৎকোচ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অভিযুক্তদের এবং তাদের পরিবার-পরিজনের সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাই করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি। যেমন ফরিদুল ইসলাম খসরু ঢাকা শহরে ১০-তলা বিল্ডিং করেছে। কীভাবে সম্ভব এত টাকার মালিক হওয়া? এদের সবার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করলে সব ধরা পড়বে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভুয়া ও ভিত্তিহীন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সিএনজি অটোরিকশার প্রতিস্থাপন দেয় বিআরটিএ। আর আমাদের (সংগঠনের) লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে মালিকদের স্বার্থ দেখার জন্য। এক্ষেত্রে সিএনজি অটোরিকশার মেয়াদোত্তীর্ণ হলে আমরা মন্ত্রণালয়ের আবেদন করি। সরকারের সঙ্গে বসে প্রতিস্থাপন করি। এ কার্যক্রমের জন্য সাত সদস্যের কমিটি রয়েছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছে। তারা বসে তারিখ নির্ধারণ করে, আমরা গাড়ি হাজির করি এরপর ভাঙা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটসহ কমিটির অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে সেখানে কারো কিছুই করার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত বিআরটিএ’র সহকারী রাজস্ব র্কমর্কতা খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে ঢাকা অটোরকিশা শ্রমিক ইউনিয়ন দুদকে যে অভিযোগ দিয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সব হয়রানিমূলক ও মিথ্যা। আমার যতটুকু কাজ আমি ততটুকু করি। আমি ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে কিছুই জানি না।

এছাড়া অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে কি না কিংবা চিনেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে হয়ত তাদের দেখা হয়েছে কিন্তু আমি তাদের চিনি না। কোনো সম্পর্ক নেই তাদের সঙ্গে।’

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close