নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

দুর্নীতি দমন সরকারের আরেক বড় পরীক্ষা

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মিরপুর কার্যালয়ে গত রবিবার অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাবু রায় নামে দালালকে ধরে দুদক প্রধান কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট টিম। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাকে সোপর্দ করা হয়। তাকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয়ে অভিযানে ধরা পড়ছে গ্রাহকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা। দুদক দল অটোরিকশায় সিএনজি প্রতিস্থাপনসহ বিভিন্ন সেবায় ধাপে ধাপে গ্রাহক হয়রানি ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে রাজধানীর বিআরটিএর মিরপুর অফিসে ওই অভিযানে যায়।

অভিযোগ আছে, আয়ুষ্কাল শেষে অটোরিকশায় সিএনজি প্রতিস্থাপন করতে বিআরটিএতে তিন ধাপে ঘুষ দিতে হয়। প্রথম ধাপে ভাঙতে দিতে হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার, এরপর নতুন নিবন্ধন নিতে ২৫ হাজার ও ভাঙা অটোরিকশা ফেরত পেতে ১০ হাজার টাকা। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ বছরে ১২ হাজার ৫০০ অটোরিকশা প্রতিস্থাপন ও মেয়াদ বাড়াতে ১১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঘুষ-বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে শুধু প্রতিস্থাপন করতেই ঘুষ নেওয়া হয়েছে প্রায় ১০৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকনের পক্ষ থেকে দুদকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে এখনো তেমন অনুসন্ধান করেনি দুদক।

গত বছরের ৪ এপ্রিল রাজশাহী কর কমিশনার অফিসে ঘুষের ১০ লাখ টাকাসহ উপকর কমিশনার মহিবুল ইসলাম ভূঁইয়াকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে দুদকের রাজশাহী জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ের সমন্বিত দল। এ ঘটনার দুদিন পর শরীয়তপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন কার্যালয়ে আরেক অভিযানে ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ উপব্যবস্থাপক মো. মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়। দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তারের ২১ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। গত ২১ জানুয়ারি দুদকের উপসহকারী পরিচালক নাঈমুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত চিঠি দিয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তার কাছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত চায় সংস্থাটি। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি চলছে। অবস্থা এমন যে এ খাতের অনিয়ম নিয়ে প্রকাশ্যে মানুষজন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। গত সোমবার রাজধানীর বিজয়নগরে এবি পার্টি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সুন্দর অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও দেশের সাধারণ জনগণ ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। তার অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রোগীদের বিদেশে যেতে বাধ্য করছে।

সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক, প্রশাসনিক বিষয় দেখভাল ও নিয়োগ এবং সনদ যাচাই করে এটি। সরকারের প্রশাসনিক আদেশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য পরিকল্পনামাফিক পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়া এ সংস্থার কর্মকর্তাদের কাজ। সংস্থার সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রতি বছর ডিআইএর কর্মকর্তারা কমপক্ষে ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। ডিআইএ গঠনের পর ৩৭ বছরে ৩৬ হাজার স্কুল-কলেজ একাধিকবার পরিদর্শন করা হয়েছে। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যে, তারা অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। দীর্ঘদিন এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতি কমার পরিবর্তে বাড়ছে। অনিয়ম প্রমাণের পর ব্যবস্থা না নেওয়া এর অন্যতম কারণ।

দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সড়কসহ বিভিন্ন খাতে অবাধে দুর্নীতি হচ্ছে। অভিযান চালাচ্ছে দুদক। কিন্তু তা দুর্নীতির-অনিয়মের তুলনায় এসব অভিযান সামান্যই। নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর অনুষ্ঠিত প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ যদি কোনো অনিয়ম করেন বা কোনো দুর্নীতি করেন, তাহলে তার কোনো মাফ নেই, ছাড় নেই। প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে এ বিষয়টি দেখবেন।

সরকারের বিভিন্ন দপ্তরসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষ। টিআইবি জানায়, দুদকের শুরুর সময়ের চেয়ে বর্তমানে অভিযান অনেক কমে এসেছে। এক সাক্ষাৎকারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একসময় দুদকের অভিযানগুলো বেশ ভালোভাবে পরিচালিত হয়েছে। পরে সেগুলো কমে গেছে এবং এখন মাঝেমধ্যে দেখা যায়। টিআইবির এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি জানায়, দুদক নিজে উদ্যোগী হয়ে কোনো অভিযান চালায় না; বরং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রাথমিক যাচাইয়ের পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য সরকারের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করা। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে আবেদন করেছে যেন তথ্য অধিকারের আইনের আওতায় তাদের রাখা না হয়। এভাবে যদি সব সরকারি প্রতিষ্ঠান এ আইন থেকে অব্যাহতি চায়, তাহলে দুর্নীতি কীভাবে দূর হবে?

দুদকের মামলা পাচ্ছে না গতি : দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে যথাযথ তদারিক অভাবে এসব মামলা গতি পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। দুদকের সর্বশেষ গত ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগে আদালতে মামলা চলমান আছে ৩ হাজার ৩৫৩টি। এর মধ্যে চলমান মামলা ছিল ২ হাজার ৯২৭ এবং উচ্চ আদালতের আদেশে বিচার স্থগিত আছে ৪২৬টি। এছাড়া সাজা হয়েছে ১৯৫টি মামলার এবং খালাস পেয়েছে ১১৮টি। অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৮টি মামলা। নিষ্পত্তির সংখ্যা ৩৪১। মামলা নিষ্পত্তি ১০.১৭ শতাংশ। মামলা নিষ্পত্তির হার কম হওয়ায়ও দুর্নীতি বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের জিরো টলারেন্সনীতি : বর্তমান সরকার সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের ইশতেহারে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠনের পরপরই এ নিয়ে কাজ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে। বৈঠকের পর গণমাধ্যম পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ থাকবে। সব মন্ত্রণালয়কে বলেছেন একই নীতি অনুসরণ করতে। এ সময় মন্ত্রিসভার এক সদস্যও প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্সনীতি সম্পর্কে জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কেউ যদি কোনো অনিয়ম করেন বা কোনো দুর্নীতি করেন, তাহলে তার কোনো মাফ নেই, ছাড় নেই। প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে এ বিষয়টি দেখবেন। বর্তমান সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনকালে দুর্নীতিতে একসময়ের শীর্ষ দেশ থেকে বেশ উন্নতি করে বাংলাদেশ।

এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে দুদকের যেমন নানামুখী পদক্ষেপ ছিল, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করার একটা প্রবণতা চালু হয়েছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে দুদকের কার্যক্রম কমেছে বলে মনে করেন দেশের সচেতন মহল। ফলে সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় ফের দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে ২০২২ সালে যেখানে দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১২তম অবস্থানে ছিল, সেখান থেকে ২০২৩ সালে দশম স্থানে অবনমন হয়। দুর্নীতিগ্রস্তদের কারণে ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের সাধারণ নাগরিকদের। বৈশি^ক মন্দা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু দুর্নীতি যেভাবে সরকারি সংস্থা থেকে বেসরকারি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বর্তমান সরকারের সামনে এটাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছে বিশেষজ্ঞ মহল।

তবে দুর্নীতি সারা বিশ্বেই কমবেশি আছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, দুর্নীতির অপবাদ যেভাবে বাংলাদেশ নিয়ে দেওয়া হয়, তা মোটেও সত্য নয়। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এশিয়ার মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ৪ নম্বরে আছে- টিআইবির প্রতিবেদনের এ তথ্যের বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওবায়দুল কাদের বলেন, টিআইবি তো বিএনপির দালাল, বিএনপি যা বলে, টিআইবিও তা বলে। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু রাজনৈতিক ইন্টারেস্ট (স্বার্থ) আছে। বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব, সেখানে অবস্থানগতভাবে কোনো কোনো জোট বা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের পাহারাদার এসব প্রতিষ্ঠান। ওখানে কারো স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এসব কমেন্ট (মন্তব্য) করা হয়। এসব অপবাদ দেওয়া হয়। এটা অতীতেও দেওয়া হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close