নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৫ আগস্ট, ২০২২

দেশে তামাকপণ্যের সহজ বাণিজ্য, আসক্তি সুবিধা

বাংলাদেশে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক ব্যবহার নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু তামাকের দুর্বল আইনের কারণে এই সময়ের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে। বিপরীতে জনগণকে তামাকে আসক্ত করতে সুবিধা পাচ্ছে তামাক ও তামাকজাত পণ্য কোম্পানিগুলো। তাই দেশকে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে আরো শক্তিশালী করার জন্য তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও দিয়েছে। সেগুলো আমলে নিয়ে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু আইন সংশোধনে যত বিলম্ব হবে তামাক নিয়ন্ত্রণ তত দূরহ হবে বলে মনে করছে সংগঠনগুলো। ফলে একদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, মৃত্যু ও অকাল পঙ্গুত্বের সংখ্যা বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদদের মতে, কিছু দুর্বলতার কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি তামাকের ব্যবহার কমাতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭ ধারায় ‘ধূমপান এলাকা’ রাখার বিধান বাতিল করতে হবে। ২০৪০ সালের তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের পাশাপাশি এই আইনের যথাযথ প্রয়োগে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা জরুরি। বিষয়টি খুব কার্যকর এবং এর ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দোকানে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, সচিত্র সতর্ক বার্তার আকার বৃদ্ধি করা প্রভৃতি বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুই বছর পর পর বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়ে রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক (জিটিসিআর) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে এফসিটিসির মূলনীতিগুলোর অনুবর্তিতা তুলে ধরা হয়। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনো সর্বোত্তম মান অর্জন করতে পারেনি।

বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসির সঙ্গে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জন্য নতুন হুমকি ই-সিগারেটের মতো এমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। আবার সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ৫০ শতাংশ জুড়ে সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণ বাধ্যতামূলক করা হলেও মোড়কের আকার নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ক্ষুদ্রাকারের মোড়কে সচিত্র সতর্কবার্তা সেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।

২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক ব্যবহার নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করারও ঘোষণা দেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান আইনের দুর্বলতাগুলো নিরসনের লক্ষ্যে এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে আইনটিকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করা হলে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, যা জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।

বিদ্যমান আইনে গণপরিবহন ও রেস্তোরাঁগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ধূমপানের সুযোগ রাখা হয়েছে, বিড়ি-সিগারেটের সিঙ্গেল স্টিক বা খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ নয়, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়নি, ই-সিগারেটের মতো এমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টগুলো আমদানি ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ বা সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়নি এবং সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের আকার বা আয়তন নির্ধারণ না করায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ও ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদন টোব্যাকো এটলাস ২০১৮ অনুযায়ী, তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। ধূমপানের কারণে বাংলাদেশে ১২ লাখের বেশি মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হন। তামাকজনিত রোগব্যাধী ও অকাল মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, তামাক ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যা ওই বছরের মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। একই বছরে প্রায় ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগেছে এবং প্রায় ৬২ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close