কক্সবাজার প্রতিনিধি

  ২০ জুন, ২০২২

রোহিঙ্গাদের ‘বাড়ি চলো’ সমাবেশ

‘ফিরে যেতে চাই জন্মভূমিতে’

‘আমরা এখানে ভালো আছি। বাংলাদেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই। তারপরও আমরা নিজ দেশ, মাটি, ভিটেমাটির জন্য প্রাণ কাঁদে। তাই দ্রুত ফিরে যেতে চাই জন্মভূমিতে।’ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এক দিন আগে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার ২১টি এবং টেকনাফ উপজেলার ২টিসহ ২৩টি ক্যাম্পে ৭ দফা দাবিতে ‘গো হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ শীর্ষক সমাবেশে এ কথা বলেন এক উখিয়া উপজেলার বালুখালীর ৮ নম্বর ডব্লিউ ক্যাম্পের রোহিঙ্গা। এদিন সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের জামতলী, বৃহত্তর কুতুপালংয়ের লম্বারশিয়া, মধুরছড়া ও বালুরমাঠ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এসব সমাবেশে কয়েক হাজার করে রোহিঙ্গা অংশ নেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচির ব্যানার-পোস্টার ক্যাম্পগুলোর অলিগলিতে শোভা পাচ্ছে। অনেক ব্যানারে ৫ বছর আগে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে দল বেঁধে বাংলাদেশ পালিয়ে আসার মুহূর্তে তোলা রোহিঙ্গাদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ছবির ওপরে-নিচে ইংরেজি, বার্মিজ ও রোহিঙ্গা ভাষায় লেখা হয়েছে স্লোগান। একটি ব্যানারে লেখা হয়েছে, ‘আমরা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) রোহিঙ্গা জাতি। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের আশ্রয়ে আছি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। ফেরত নিয়ে যাওয়ার আইনি সরকারও নেই মিয়ানমারে। সুতরাং আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। চলো বাড়ি ফিরে যাই।’ সকাল সাড়ে ১০টায় বালুখালীর ১৮ নম্বর ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ের সামনের সড়কে সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকের মাঝি শাহাবুদ্দীন, নুরুল আমিন, মাস্টার মোহাম্মদ আয়াজ ও মৌলভী ইউসুফ। তারা বার্মিজ, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দেন।

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনবিরোধী মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কমান্ডার মাস্টার আবদুর রহিমের নেতৃত্বে একদল বন্দুকধারীর গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষের শীর্ষ নেতা মোহিবুল্লাহ। মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপন করেন ক্যাম্প থেকে।

বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বি ব্লকের এমণ্ড১৯ এর মাঝি রশিদুল হক (৫৮) বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল সাধারণ রোহিঙ্গারা। সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মোহিবুল্লাহ সহমত পোষণ করেছিলেন। তিনি খুন হওয়ার ৬ মাস আগে ঘোষণা করেছিলেন ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা কর্মসূচির। তার অনুপস্থিতিতে আমরা সাধারণ রোহিঙ্গারা ওই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছি। আমাদের কর্মসূচি হবে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। আয়োজকদের একজন ই ব্লকের এমণ্ড৫ এর মাঝি জাহিদ হোসেন বলেন, সোমবার বিশ্ব শরণার্থী দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সব রোহিঙ্গা ক্যাম্প একসঙ্গে পৃথক স্থানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মানববন্ধনে অংশ নিয়েছি। আমার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আরাকান রাজ্য (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) আমাদের জন্মভূমি। আমরা জন্মভূমিতে ফিরতে চাই।

বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এমণ্ড১২ ব্লকের হেড মাঝি মোহাম্মদ আক্কাস (২৮) বলেন, মিয়ানমার জান্তা সরকারকে চাপ প্রয়োগে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সাধারণ রোহিঙ্গারা ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

সমাবেশে ‘প্রিয় বিশ্ব সম্প্রদায়, জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি’ শিরোনামের যে প্রচারপত্রটি বিলি করা হয়েছে সেখানে উল্লেখিত ৭ দফা দবিগুলো হলো অতি দ্রুত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা, মিয়ানমার সরকারের ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন বাতিল, অতিসত্বর বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তাদের মিয়ানমারের নিজ গ্রামে যথাযথভাবে পুনর্বাসন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য দ্রুত সময় নির্ধারণ করা, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আইডিপি ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে পুনর্বাসন করা ও মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন বন্ধ করা।

রোহিঙ্গাদের আজকের প্রচারণা কর্মসূচির বিষয়ে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে চান, তাদের অধিকারের কথা জানাতে চান বিশ্ববাসীকে। সেটি জানানোর জন্য রোহিঙ্গারা জড় হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আমরা বাধা দিইনি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার আশফাকুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করতে আগে থেকেই পুলিশের অনুমতি নিয়েছেন। তারা আজকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করেছেন। সমাবেশস্থলে পুলিশের কড়া নজরদারি ছিল। সমাবেশ যাতে কেউ বানচাল করতে না পারে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সেজন্য গতকাল রাতে ক্যাম্পে পুলিশ ব্যাপক সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে।

আরআরআরসি কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৮ লাখ ৯০ হাজার মতো রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। তবে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close