নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৪ মে, ২০২২

গরুর মাংসের দাম এত বেশি কেন?

রাজধানী ঢাকায় এখন প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০-৭৫০ টাকায় এবং খাসির মাংস প্রতি কেজি ৮৫০-১০০০ টাকায় বিক্রি করছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এই মাংসের প্রতি কেজির দাম ৪.৯০ ডলার বা টাকা ৪০০ টাকা। যা বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।

আবার প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে মহিষের মাংসের দাম প্রতি কেজি ২০০-৩০০ রুপি যা টাকায় হিসাব করলে ২৩৫-২৭০ টাকা। জানা গেছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হিসেবে ভারতের গরুর মাংস রপ্তানি নিষিদ্ধ করা, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এবং গবাদি পশুর খাদ্যের উচ্চমূল্য দেশের গরুর মাংসের দাম বাড়ার অন্যতম কয়েকটি কারণ। ঈদুল ফিতরের ঠিক আগে গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৬৫০-৭০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। যা এক মাস আগে মার্চ মাসেও ৬০০ টাকা ছিল।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ভারত বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে ঢাকার বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ২৩০-২৫০ টাকা। নিষেধাজ্ঞার আগে চোরাচালান করা ভারতীয় গরু বাংলাদেশের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করত। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা প্রায় ২০ লাখ গরু বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। ২০১৫-১৫ অর্থবছরে গরুর মাংসের বিশ্বব্যাপী গড় মূল্য ছিল ৪.৬৩ ডলার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিময় হারের ওপর ভিত্তি করে হিসেব করলে প্রতি কেজি প্রায় ৩৬০ টাকা।

দাম বাড়ার কারণ কী : ভারতের গবাদি পশু রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে প্রাণিসম্পদ খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য সত্ত্বেও গত সাত থেকে আট বছরে বাংলাদেশে গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়েছে। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, মোদি সরকার বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। যা বাংলাদেশের পশুসম্পদ খাতের ব্যাপক উন্নয়নে সহায়তা করেছিল বলে এক দুগ্ধ খামার মালিক বলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের কর্মচারী আবদুর রহমান বলেন, গরু ও খাসির মাংসের দাম নিম্ন ও মধ্যম আয়ের গ্রাহকদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারণত রমজান মাসের আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন গরুর মাংস ও মাটনের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এ বছর তা করেনি। বিডিএফএর সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরানের মতে, সরকারি পদক্ষেপ এবং প্রণোদনা বাংলাদেশে মাংসের দাম ২০-২৫ শতাংশ কমাতে সাহায্য করতে পারে। পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে গবাদি পশু পালনে খরচ বেশি। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ যেখানে গবাদি পশুর চারণভূমি দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। ভৌগোলিকভাবে, ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই বাংলাদেশের চেয়ে যথাক্রমে ২৫ এবং ৭ গুণ বড়। তাই এই দুই দেশেই তৃণভূমি ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়, তিনি বলেন।

কী করা প্রয়োজন : বাংলাদেশে পশুখাদ্যের দামও বেশি। তবে টিসিবি পণ্যটি আমদানি করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করলে এই পণ্যের দাম কমবে বলে এমরান জানান। তিনি দুগ্ধ খামারগুলোতে পণ্যের স্থানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করতে সয়াবিন রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও প্রস্তাব করেন। দুগ্ধ খামারের বিদ্যুতের দাম, বাণিজ্যিক ও গৃহস্থালির মতো একটি বিশেষ হার অনুসারে থাকা উচিত। বিডিএফএর সাধারণ সম্পাদক বলেন, বর্তমান সরকারের নীতি গরু পালনকে উৎসাহিত করে, তাই বিদ্যুতের দাম বাণিজ্যিক নয়, স্বাভাবিক হওয়া উচিত।

প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সরকারের উচিত দুগ্ধ খামারিদের ৩-৪ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা তৈরি করা এবং মাংসের উৎপাদন বাড়াতে দেশে ব্রাহ্মণ, সিমেন্টাল ও অ্যাঙ্গাসের মতো জাতের গরু আমদানিতে উৎসাহিত করা। একই কথা ছাগলের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে, এমরান বলেন। উদাহরণস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, আসাম, উত্তর ওড়িশা এবং বাংলাদেশে পাওয়া একটি পুরুষ প্রাপ্তবয়স্ক ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ওজন প্রায় ১৮-২০ কেজি এবং মাদি প্রাপ্তবয়স্ক ছাগলের ওজন ১৫-১৮ কেজি। সরকারের উচিত আফ্রিকান জাতের যেমন বোয়ার বা কালাহারি এবং ভারতীয় জাতের তোতাপুরি ও যমুনাপারির মতো ছাগল মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমদানির অনুমতি দেওয়া।

ডিপার্টমেন্ট অব লাইভস্টক সার্ভিসেসের (ডিএলএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন মাংস উৎপাদন করেছিল, যা ২০২০ অর্থবছরে বেড়ে ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে। গত ৭-৮ বছরে বেশকিছু শিক্ষিত তরুণ গবাদি পশু পালনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ফলে বাংলাদেশ গবাদি পশু পালনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে, ডিএলএসের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন। আগে কোরবানির মৌসুমে আমাদের ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভর করতে হতো কিন্তু স্থানীয়ভাবে পালন করা ষাঁড়ই ঈদ উদযাপনে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে পারে। এই ক্ষেত্রের সম্ভাবনা অনুধাবন করে এখন বেশকিছু মানুষ এই ব্যবসায় প্রবেশ করছে।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সম্প্রতি ৫০ হাজার মানুষ এই ব্যবসায় যোগ দিয়েছে যারা সবাই শিক্ষিত এবং যাদের মধ্যে অনেকেই স্নাতক পাস। বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ বেশি কারণ আমাদের বেশি দামে ফিড কিনতে হয়। সুতরাং গরুর মাংসের দাম এখনো বেশি এবং ভোক্তাদেরই এই মূল্য দিতে হবে। ভারতের বর্ধিত সতর্কতার আগে, গ্রামের কৃষকরা সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে গবাদি পশু পালন করত। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষিত যুবক ও গ্রামীণ কৃষকরাও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের গরু লালন-পালন শুরু করেছে।

কয়েক বছর আগে মোটাতাজা ষাঁড়ের পরিসংখ্যান সংগ্রহ শুরু করা এক গবেষণায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেখেছিল, ২০১৭ সালে দেশে ৩ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ভালো জাতের ও স্বাস্থ্যের ষাঁড় ছিল। যা ২০২১ সালে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ৮৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারত থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্তে আনা গবাদি পশুর সংখ্যা ২০১৪ অর্থবছরে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন ছিল। ২০২০ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ যা আগের বছরের ৫ লাখ ৪২ হাজারের থেকে অর্ধেকেরও কম। মাত্র ৬ বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ কমে গেছে। ডিএলএসের মতে, বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯৮ হাজার গবাদি পশুর খামারি রয়েছে, যা ২০১৫ সালে ৩ লাখ ছিল।

শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের মতে, মাংসের দেশীয় চাহিদার সিংহভাগই পোলট্রি মুরগি দিয়ে পূরণ করা হয়। যদিও গবাদি পশু পালন বাড়ছে, তবুও দামে প্রভাব ফেলার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়। ডিএলএসের এক কর্মকর্তা বলেন, গরুর মাংস উৎপাদনের উন্নতির জন্য জাতগুলোর বিকাশ প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ১১ দশমিক ৮ মিলিয়নের তুলনায় এবারের ঈদের জন্য ৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন গরু ও মহিষসহ ১২ মিলিয়ন কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। গবাদিপশুর জন্য চড়া দাম গবাদি পশুর উচ্চমূল্যের আরেকটি কারণ। কেননা, কৃষকরা গত চার মাস ধরে ৩৭ কেজি খাদ্যের বস্তা প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা দিয়ে কিনছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close