জিয়াউদ্দিন রাজু

  ৩১ জুলাই, ২০২১

বড় দুদলেই ভুঁইফোড়

আওয়ামী লীগে দেড় শতাধিক

টানা তৃতীয়বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির দুঃসময়ে ‘লীগ’ ব্যবহার করে গড়ে ওঠা ‘ভুঁইফোড়’ সংগঠনগুলোকে দেখা যায় না। তবে দলের সুসময়ে এসব সংগঠনের অভাব হয় না।

দলের দপ্তরসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন খোলার প্রবণতা শুরু হয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। সারা দেশে এই ধরনের সংগঠনের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও তা দেড় শতাধিকের কম হবে না বলে দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সংগঠনগুলোর নেতাদের কর্মকান্ডে সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতারাও বিব্রত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এদের এখনই যদি দল থেকে বের করে দেওয়া না হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে বিশাল অর্জন, তা এদের কারণে সেগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে। কারণ এরা কেউই আদর্শবাদী নয়, এরা সবাই মতলববাজ।’

জাহাঙ্গীর কবির নানক আরো বলেন, এদের বিষয়ে দলের দায়িত্বশীল নেতা, এমপি ও মন্ত্রীদের সতর্ক হওয়া উচিত। ক্যামেরা দেখলেই ছবি উঠানোর প্রবণতা বন্ধ করা উচিত। যেভাবেই হোক এদের শক্তভাবে প্রতিহত করতে হবে।

সম্প্রতি ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরের কর্মকান্ড নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামের একটি সংগঠন গঠন করেন। এটির কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নাম আসে হেলেনা জাহাঙ্গীরের। আর সাধারণ সম্পাদক করা হয় মাহবুব মনিরকে। পোস্টারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সংগঠনটির দাবি, দুই থেকে তিন বছর ধরে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।

যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সংগঠনটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। হেলেনা জাহাঙ্গীর দলের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য হওয়ায় সমালোচনার ইঙ্গিত উঠে ক্ষমতাসীন দলের উপকমিটির দিকে। এ ঘটনার পর তাকে আওয়ামী লীগের উপকমিটি ও কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সর্বশেষ নিজ বাসায় ক্যাসিনো সামগ্রী, পশুর চামড়া, বিদেশি মদসহ নানা অবৈধ জিনিস বাসায় রাখার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আটক করেছে। তবে তার এই বিতর্কিত কর্মকান্ডে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে হেলেনা জাহাঙ্গীরের ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের কেউ কেউ এসব ভুঁইফোড় সংগঠন গজে ওঠার পেছনে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের একটি অংশের দিকে অভিযোগের তির ছুড়ছেন। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের কিছু কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ও সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে সংগঠন করার সাহস পাচ্ছে। এসব নব্য আওয়ামী লীগার, ধান্ধাবাজদের আশ্রয়-প্রশয় দেওয়া বন্ধ হলে ভুঁইফোড় সংগঠনের তৎপরতা ও দৌরাত্ম্য কমে আসবে বলেও মনে করেন তারা। তাই আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এসব বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তারা দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আমাদের দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সহযোগী সংগঠন রয়েছে। এই সহযোগী সংগঠনের বাইরে নিজেদের মনগড়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুবিধালোভীরা নিজেদের বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করছে। এসব কর্মকান্ড চালানো ব্যক্তিদের সম্পর্কে আগেই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এসব মতলববাজ এবং অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে আমাদের নেত্রীর। আমি দলের সবাইকে সতর্ক হতে বলব। প্রয়োজনে দলের যেসব নেতার মহব্বতে ও করুণায় বা যাদের হাত ধরে এ ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিরা দলে প্রবেশ করছে তাদের চিহ্নিত করা উচিত।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন রয়েছে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ।

এছাড়া অঙ্গসংগঠন হিসেবে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, মহিলা শ্রমিক লীগসহ কয়েকটি সংগঠন আছে আওয়ামী লীগের। দলের গঠনতন্ত্রে লীগ নামে আর কোনো সংগঠনের ভিত্তি নেই। বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের মতো কিছু সংগঠন পঁচাত্তরের পর বৈরী পরিবেশে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করেছে তাই এসব সংগঠনের কর্মকান্ডে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয় আওয়ামী লীগ। এর বাইরে দলটির আর কোনো সংগঠনের রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক স্বীকৃতি নেই বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন।

তারপরও আওয়ামী লীগের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বহু ভুঁইফোড় সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, জাতীয় শিশু কিশোর লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী সোনার বাংলা লীগ, আওয়ামী হকার্স লীগ, আওয়ামী বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতি, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, মোটর চালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি লীগ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী অনলাইন লীগ, বিশ্ব আওয়ামী অনলাইন লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী পর্যটন লীগ, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা পরিষদ, তৃণমূল লীগ, চেতনায় মুজিব, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ঘাট শ্রমিক লীগ, আমরা নৌকা প্রজন্ম, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো বাহারি নামের নানা সংগঠন রয়েছে।

দলের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের রয়েছে সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং বিভিন্ন উপকমিটি উল্লেখ করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে যে কোনো নামের সঙ্গে ‘লীগ’ বা ‘আওয়ামী’ শব্দ জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে নানা সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং বসন্তের কোকিলরা এ ধরনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়, যুক্ত হয় নানা আগাছা-পরগাছা। দলীয় সভানেত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দলের মধ্যে কারো প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। যে কারো সঙ্গে ছবি তোলার বা যে কোনো অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার আগে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব কিছুই সামনে চলে আসে, কিছুই গোপন থাকে না। তাই এমন কাজ করা উচিত নয়, যার মাধ্যমে নিজেকেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় বা দল ও সরকারকেও বিব্রত হতে হয়। হেলেনা জাহাঙ্গীরের এই ঘটনার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা এসব সংগঠন নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ময়ূরের পেখম লাগালেই কাক কখনো ময়ূর হয় না। তেমনি নামের সঙ্গে ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার করলেই আওয়ামী লীগ হয়ে যায় না। আওয়ামী লীগ একটা আদর্শ। এটাকে ধারণ করতে হয়। দলের গঠনতন্ত্রের বাইরে কোনো সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নেই।’ আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করার জন্যই নাম ব্যবহার করে এসব সংগঠন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই।

আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের তথ্য নেই জানিয়ে দলটির উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে দলীয় নাম ব্যবহার করে সারা দেশে শত শত ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠছে। তবে এদের বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে কোথাও কোনো সংগঠন গড়ে তোলার খবর পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অবহিত করছি। আর দলের কেউ এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার বিরুদ্ধেও দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close