নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০১ অক্টোবর, ২০২০

সংসদে কোরাম সংকটের অর্থমূল্য ২২ কোটি টাকা

টিআইবি

একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম বছরের পাঁচ অধিবেশনে কোরাম সংকটে যে সময় ব্যয় হয়েছে, তার অর্থমূল্য ২২ কোটি টাকার বেশি। একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশন নিয়ে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন পার্লামেন্ট ওয়াচে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গতকাল বুধবার এক ওয়েবিনারে এটি উপস্থাপন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম পাঁচটি অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ৬১টি। প্রতিদিন গড়ে ১৯ মিনিট ছিল কোরাম সংকট। মোট কোরাম সংকট ছিল ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট। কোরাম সংকটের এই সময়ের আর্থিক মূল্য ২২ কোটি ২৮ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।

ওয়েবিনারে তিনি বলেন, অষ্টম ও নবম সংসদে সমস্যার মূল যে জায়গা সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি অগ্রহণযোগ্য ছিল। সেটি বন্ধ হয়েছে চড়া দামে। এত বেশি চড়া দামে যে মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো হয়েছে।

২০১৯ সালে সংসদের (প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন) কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এবারের এই ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’-প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে টিআইবি।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সংসদের প্রথম বৈঠক বসে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি। দশম সংসদ বর্জন করা বিএনপি এই নির্বাচনে যোগ দেওয়ার পর ঘটে নানা নাটকীয়তা। ৩০ ডিসেম্বর ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র ছয়টি আসনে জয় পায় বিএনপি। আর গণফোরামের দুটি মিলিয়ে তাদের জোট ঐক্যফ্রন্ট পায় মোট আটটি আসন।

ওয়েবিনারে এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিরোধী দল থাকলে সংসদ বর্জন করে, সেই সংস্কৃতি আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। বর্জন বন্ধ হয়েছে। কারণ কার্যকর বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় সেটি আমাদের কাছে নেই।

‘এবারে সংসদে যাদের প্রধান বিরোধী দল বলা হয়েছে বা উপস্থাপন করা হয়েছে তারা কিন্তু বিরোধী দলে বসবেন সেই প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচন করেননি। তারা ক্ষমতাসীন জোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের বসানো হয়েছে বা বসেছেন এমন একটি ভূমিকায় যেটার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। বাস্তবে প্রধান বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় সেটি কিন্তু অনুপস্থিত।’

প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, ‘সংসদীয় উন্মুক্ততার চর্চায় ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে আইন প্রণয়নসহ অন্যান্য সংসদীয় কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সংসদে আলোচনার ক্ষেত্র এখনো সন্তোষজনক নয়। সার্বিকভাবে, একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম পাঁচটি অধিবেশন আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না।’

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের হলফনামায় উল্লেখ করা প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে, ৬১ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী, আইনজীবী প্রায় ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক মাত্র ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ২১ শতাংশ।

অন্যান্য পেশার মধ্যে শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিণী, পরামর্শক ইত্যাদি পেশা উল্লেখযোগ্য। আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের ৫৯ শতাংশ এবং জাতীয় পার্টির ৫৬ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী।

ভারতের পার্লামেন্টের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেশী দেশটির সপ্তদশ লোকসভায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক ৩৯ শতাংশ, ব্যবসায়ী ২৩ শতাংশ, আইনজীবী ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ৩৮ শতাংশ।

টিআইবি গত কয়েকটি সংসদের সদস্যদের প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে বলছে, প্রথম সংসদে আইনজীবীদের হার ছিল ৩১ শতাংশ, যা ক্রমাগত কমে একাদশ সংসদে ১৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের হার প্রথম সংসদে ১৮ শতাংশ ছিল, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে একাদশ সংসদে ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে।

টিআইবি বলছে, একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ।

টিআইবি বলছে, অধিকাংশ সংসদীয় কমিটিতে বিলের ওপর আলোচনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। বিলের ওপর সংশোধনী এবং যাচাই-বাছাই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়েছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল ৬৭ শতাংশ, অন্যান্য বিরোধী সদস্য ১৭ শতাংশ, সরকারি দল ১৬ শতাংশ (বিল উত্থাপনকারী মন্ত্রীরা) সময় ব্যয় করেছেন।

৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৪ জন সদস্য (৪ শতাংশ) বিলের ওপর নোটিস দিয়ে আলোচনা করেছেন। যাদের মধ্যে আটজন সদস্য বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বাকি সদস্যদের ভূমিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে তথ্য দিয়েছে টিআইবি।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিল পাসের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সরকারি দল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।’

সংসদ নিয়ে এই প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের যথাযথ আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য, সংসদে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক শব্দের’ ব্যবহার অব্যাহত ছিল।

সংসদকে কার্যকর করতে কয়েকটি সুপারিশও করেছে টিআইবি। এরমধ্যে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদ সদস্য আচরণ আইন প্রণয়ন, সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিতকরণ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close