প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৩ এপ্রিল, ২০১৯

রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা

জঙ্গি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৯০

* লক্ষ্য ছিল ইস্টার সানডেতে জড়ো হওয়া বিদেশি পর্যটক * জঙ্গি দল তাওহীদ জামায়াতের দায় স্বীকার

একের পর এক বিস্ফোরণে শ্রীলঙ্কার গির্জা ও অভিজাত হোটেলগুলো কেঁপে উঠল। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় ভয়াবহ বোমা হামলা ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে মৃত্যুপুুরীতে পরিণত করে। গত রোববার বিস্ময়ে বিমূঢ় নতুন এক ভোর এসেছিল দেশটির রাজধানী কলম্বোয়। ওইদিন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় উৎসব ইস্টার সানডে। হামলার সময় তিন গির্জায় ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলছিল। হামলায় বাংলাদেশিসহ ২৯০ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন প্রায় ৫০০ জন। ধারাবাহিক বিস্ফোরণে তছনছ হয়ে গেছে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি। এরই মধ্যে হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে জঙ্গি দল ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত (এনটিজে)। তবে শ্রীলঙ্কা বলছে, হামলায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত। স্থানীয় কোনো দল এভাবে হামলা চালাতে পারে না। এদিকে, ন্যক্কারজনক ওই প্রাণঘাতী হামলার ঘটনায় আজ মঙ্গলবার দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। হামলার পর গুজব রোধে শ্রীলঙ্কা সরকার দেশটিতে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের সন্দেহের কথা জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রজিথা সেনারতœ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি না যে, এই হামলা শুধু দেশের ভেতরে একটি গোষ্ঠী চালিয়েছে। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এ হামলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’ হামলার ঘটনায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। জাতির উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আমাদের জনগণের ওপর আজ যে কাপুরুষোচিত হামলা চালানো হয়েছে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এই দুঃখজনক সময়ে আমি শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। দয়া করে যাচাই-বাছাই না করে কোনো গুজব ছড়াবেন না। সরকার অবিলম্বে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বলেন, ইস্টার সানডের সকালে যেসব গির্জায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আপনারা শান্ত থাকুন। নিরাপত্তা বাহিনী এই বোমা হামলার তদন্ত শুরু করেছে।

আর দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে দেশটির ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান আর্চ বিশপ অব কলম্বো ম্যালকম কার্ডিনাল রঞ্জিত আহতদের রক্ত দিতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।

নিহতদের মধ্যে শ্রীলঙ্কানদের পাশাপাশি ৩২ বিদেশি রয়েছেন। যাদের মধ্যে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, ভারত, ডেনমার্ক, চীনসহ আরো কয়েকটি দেশের নাগরিকরা আছেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি ৮ বছরের জায়ান চৌধুরী হামলায় নিহত হয়েছে। জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্স হামলায় আহত হয়ে কলম্বোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ সেলিম এমপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই।

শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান পুজুথ জয়সুন্দর গত ১১ এপ্রিল দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি দল ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত (এনটিজে) কলম্বোয় ভারতীয় হাইকমিশন ও শ্রীলঙ্কার প্রধান গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু পুলিশ প্রধানের ওই সতর্কবার্তা আমলে না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, আমাদের এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি।

শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের পর গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই হামলার শিকার হলো দেশটিতে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের তিনটি বড় গির্জা সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চ, সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ আর জিয়ন চার্চে। হামলার লক্ষ্য ছিল কলম্বোর পাঁচ তারকা হোটেল শাংরি লা, কিংসবুরি আর সিনামন গ্র্যান্ডের বিদেশি পর্যটকরা।

এছাড়া গির্জা ও হোটেলসহ আট জায়গায় প্রাণঘাতী বোমা হামলার পর মসজিদেও পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া মুসলিম মালিকানাধীন দুটি দোকানেও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে ওই ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩২ জন বিদেশি নাগরিক রয়েছেন। পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বিস্ফোরণের খবরটি আসে রোববার স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে। ইস্টার সানডে উপলক্ষে গির্জাগুলোতে তখন চলছিল বিশেষ প্রার্থনা। এর মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে নির্মিত কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এছাড়া কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ এবং বাত্তিকালোয়ার জিয়ন গির্জাও শ্রীলঙ্কায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাসনালয়। বিস্ফোরণে প্রতিটি গির্জাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছাদ উড়ে যায়। বিধ্বস্ত গির্জাগুলোর বেঞ্চ আর যিশুর ভাস্কর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর দৌড়ে সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চে গিয়ে মেঝেতে লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। সংবাদ মাধ্যমকে কামাল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, পৌনে ৯টার দিকে বিকট ওই বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। এরপর লোকজন দৌড়ে বের হয়ে আসতে দেখি। তারা চিৎকার করে অনেক লোকের মৃত্যুর কথা বলছিলেন। আমরা দৌড়ে গির্জার ভেতরে গিয়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা প্লাস্টিক দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিলাম। এরপর পুলিশ এসে সবাইকে সেখান থেকে বের করে দিল।

প্রায় একই সময়ে বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর শাংরি লা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবুরি হোটেলে। প্রতিটি হোটেলের রেস্তোরাঁয় তখন সকালের নাশতা সারতে আসা পর্যটকদের ভিড় ছিল। আর সেই পর্যটকরাই ছিল আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট।

শ্রীলঙ্কায় বেড়ে ওঠা ৪৮ বছরের চিকিৎসক জুলিয়ান ইমানুয়েল পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে কলম্বো এসে তারা উঠেছিলেন সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে।

ইমানুয়েল বলেন, বিকট বিস্ফোরণের সময় আমরা হোটেলের ঘরেই ছিলাম। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাদের ঘর কেঁপে উঠল। পরে আমাদের হোটেলের লাউঞ্জে নিয়ে আসা হলো, পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে বলা হলো। সেখানে আমরা কয়েকজন হতাহতকে দেখতে পেলাম তাদের তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সকালের নাশতা খেতে যেতে তার সামান্য দেরি হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক কিরণ আরাসারতœম।

তিনি বলেন, এত জোরে শব্দ হয়েছিল যে আমি বজ্রপাত ভেবেছিলাম। সবাই আতঙ্কে ছুটাছুটি শুরু করে। বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারেনি আসলে কী হয়েছে। লোকজনের শার্টে রক্ত লেগে ছিল, ছোট একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছিল দেয়াল, মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।

কেন ইস্টার সানডে : শ্রীলঙ্কায় সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে মধ্যে সিকি শতাব্দী ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। এরপর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপ দেশ হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় গন্তব্য। শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিদের মধ্যে ১৩ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলমান আর ৭ শতাংশ খ্রিস্টান।

ইস্টার সানডেতে খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো থাকে জমজমাট। এই সময়টায় পর্যটকরাও ছুটি কাটাতে আসেন। হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি নিশ্চিত করার জন্যই ইস্টার সানডে এবং গির্জা ও হোটেলগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে। গত বছর একটি বৌদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শ্রীলঙ্কার উগ্রপন্থি মুসলিমদের সংগঠন ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের নাম খবরে এসেছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close