নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯

ঘরেই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন ৬৬ শতাংশ নারী

ঘরেই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন দেশের ৬৬ ভাগ নারী। গণমাধ্যমে বাড়ির বাইরের সহিংসতা এবং যৌন সহিংসতাকে বেশি তুলে ধরা হলেও প্রকৃতপক্ষে নারীরা ঘরেই বেশি অনিরাপদ। বেসরকারি দাতা সংস্থা অ্যাকশন এইডের একটি গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি অ্যাকশন এইডের সহায়তায় পরিচালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির কনসালটেন্ট আহমেদ ইব্রাহিম। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের হল রুমে এই গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়, প্রচলিত ধারণা এবং পিতৃতান্ত্রিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস হচ্ছে ‘নারীরা ঘরেই বেশি নিরাপদ’। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে নারীদের প্রতি বেশিরভাগ সহিংসতা বাড়িতে সংগঠিত হয়। ঘরের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন নারীই নানাভাবে পরিবারের লোকজনের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশের ২০টি জেলায় সংঘটিত সহিংসতার তথ্য, পুলিশের কাছে রিপোর্ট হওয়া অভিযোগ, বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম, জে এন এন পি এফের নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাবিরোধী সরকারি সংস্থা এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মিডিয়া প্রতিবেদন থেকে নেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এ গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন।

এ গবেষণায় বলা হয়েছে, নারীরা ঘরেই বেশি নিরাপদ এই প্রচলিত বিশ্বাস এমন একটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, জনপরিসরে নারী নিরাপত্তাকে তা আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এখন পর্যন্ত কোনো আইনই এটা মানতে রাজি নয় যে, বিয়ের পর নারীরা ধর্ষণের শিকার হতে পারে।

গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলোর প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটি মামলাই আদালতে উত্থাপিত হতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তারপর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের পক্ষে বিচার পায়, ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির শুনানির পর্যায়ে যায় না বা গেলেও বাতিল হয়ে যায়। আদালত মামলা খারিজ করে দেওয়ার বা আসামিকে খালাস দেওয়ার সম্ভাবনা ৩২ শতাংশ। শুধু মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ মামলা থাকে পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত। যদিও বেশির ভাগ অভিযোগ পারিবারিক সহিংসতা অভিযোগ পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৭৫ শতাংশ প্রতিবেদনে ধর্ষণ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ সম্পর্কিত।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য মতে, সহিংসতা প্রতিবেদন কম হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অভিযোগ দাখিল সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকে না, এলাকার ক্ষমতাসীনদের বাধা এবং হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাব, ঘরে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রম না থাকা, মামলার ধীরগতির কারণে ভুক্তভোগীরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে চায় না, বেশিরভাগ সময়ই ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে রায় যায়, যা তাদের আরো সমস্যায় সমস্যায় ফেলে দেয়।

অনুষ্ঠানে কর্ম এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ২০০৯ বাস্তবায়ন বিষয়ক পৃথক একটি গবেষণাপত্রও উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন। এতে বলা হয়েছে, কর্ম এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন একটি তাৎপর্যপূর্ণ রায় বা নির্দেশনা ঘোষণা করে। তবে এ নির্দেশনা প্রণয়নের দীর্ঘ ৯ বছর পরও কর্ম এবং এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা বা কৌশল হাতে নিতে দেখা যায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির কথা জানেন না। ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে জানেন না।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অসচেতনতার উল্লেখযোগ্য অভাবের কথা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অন্যদিকে ১৪ শতাংশ উত্তরদাতা নির্দেশনা সম্পর্কে জানলেও এ বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা তাদের নেই।

এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বেশকিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। সুপারিশে গণমাধ্যমকে পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে নজর দেওয়ার জন্য এবং সরকারকে দেশের আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর ফারিয়া চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল করিম, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন প্রমুখ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close