প্রতীক ইজাজ

  ২০ অক্টোবর, ২০১৮

মধ্য ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন

আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকার

এ মাসের শুরুর দিকেও একাদশ জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচনের তফসিল নিয়ে বেশ সরব ছিল দেশের রাজনীতি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তখন এসব ইস্যু নিয়ে নতুন করে বক্তব্য দিলে এক ধরনের অস্পষ্টতা দেখা দেয়। তখন সিইসি বলেছিলেন, ডিসেম্বর মাসে আগামী জাতীয় নির্বাচন হবেÑ এমন কোনো কথা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। কবে তফসিলের তারিখ ঘোষণা হবে, তাও ঠিক হয়নি। একইভাবে ‘কোনো অন্তর্বর্তীকালীন, নির্বাচনকালীন সরকার হবে না। সরকার যেটা আছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সরকারই থাকবে। তবে সরকার তখন রুটিনওয়ার্ক করবে’Ñ সরকারের সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

গত বৃহস্পতিবার ‘নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে’Ñ ইসির এমন বক্তব্যে নির্বাচন ঘিরে এসব অস্পষ্টতার অবসান ঘটে। এমনকি ইসি সূত্রগুলো ১৬ ডিসেম্বরের পর সে মাসের যেকোনো দিন নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। সূত্রমতে, আগামী ১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কমিশনের সাক্ষাৎ করার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সাক্ষাতের পর ৪-৭ নভেম্বরের মধ্যে যেকোনো দিন তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। এমনকি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরীক্ষার সময়সূচি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছে ইসি সচিবালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইসিকে জানিয়েছে, আগামী ১৪ ডিসেম্বরের আগেই সব পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশনা পেয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও।

ফলে দুই দিন ধরে আবারও সামনে চলে এসেছে নির্বাচনের নানা ইস্যু। ৩০ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে। আর তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। ফলে কবে ও কেমন হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারÑ এ মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিষয়টি। বিশেষ করে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সবাইকে নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তোলায় ঘুরেফিরে এসব ইস্যু আবারও সামনে চলে আসছে। অবশ্য বরাবরের মতো এখনো সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিএনপি ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দাবিগুলো সংবিধানবিরোধী এবং সংবিধান সংশোধনীর পর্যায়ের। এ মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো ইচ্ছা নেই সরকারের। তাই সংবিধানের বিধান মেনেই একাদশ নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই করতে হবে। এ ব্যাপারে গতকালও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকার সংবিধানের বাইরে যাবে না। যেসব দাবি-দাওয়া আসছে সেগুলো সংবিধান পরিপন্থী এবং অগ্রহণযোগ্য। সংবিধান এগুলো গ্রহণ করবে না। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তারিখে নির্বাচন হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কবে নির্বাচন ও নির্বাচনের সময় কেমন সরকার হবে, তা সময় হলেই সবাই জানতে পারবে। তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নিশ্চয় তারা তাদের বিধির মধ্যে থেকেই তফসিল ঘোষণা করবে। সুতরাং এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বেরও সুযোগ নেই।

কবে তফসিল ও ভোটগ্রহণ : জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা ধারণা দেন, আগামী ২০ ডিসেম্বর বা তার আগেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হতে পারে। কারণ আগের নির্বাচনগুলোর ভোট হয়েছিল তফসিল ঘোষণার ৪০-৪৫ দিনের ব্যবধানে। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ও ভোটগ্রহণ হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এতে তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণে সময়ের ব্যবধান ছিল ৪০ দিন। এবারও ২ ও ৩ নভেম্বর সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিজয় দিবসের উৎসবের পরপরই ১৮ থেকে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোনো দিন ভোটগ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

কবে ও কেমন হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার : আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনিই ভালো জানেন কবে নাগাদ ও কী ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার হবে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, অক্টোবরের একেবারে শেষের দিক থেকে শুরু করে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় এই সরকার গঠন হতে পারে।

সর্বশেষ গত ৮ অক্টোবর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেদিন গণভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার রুটিন কাজ ছাড়া বড় সিদ্ধান্ত নেবে না। একটা সরকার পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। কিন্তু ওই পাঁচ বছরের সময় শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন সরকার শুধু রুটিন কাজগুলো করতে পারে। এখন আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছি।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। তবে এর আকার নির্ধারণ করার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনিই এটি নির্ধারণ করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী ৩০ জনের মতো সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করতে পারেন। এই মন্ত্রিসভায় কারা আসবেন, কারা বাদ পড়বেন, শরিকদের মধ্য থেকে কাউকে নেওয়া হবে কিনা; তা প্রধানমন্ত্রী জানেন।

আইনজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে মন্ত্রিপরিষদ ছোট আকারে করতে পারেন। নির্বাচনকালীন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার বলে সংবিধানে কোনো সরকার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ নেই।

এ ব্যাপারে সংবিধানের ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’

এর আগে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সব দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ছোট সরকার গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের নভেম্বরে গঠিত নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় ২১ জন মন্ত্রী ও সাতজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকায় সেবার নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও তারা অংশ নেয়নি। এমনকি ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের জন্য খালেদা জিয়াকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি।

সংসদ ভেঙে দেওয়ার ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের সুযোগ নেই : নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি করে আসছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, তার কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদ বহাল থাকবে। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা সংবিধানে কিছুই বলা নেই। সরকার যদি চায় সংসদে যারা আছেন তাদের দিয়ে অথবা বাইরে থেকে টেকনোক্রেট হিসেবে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারেন। তবে এটা কীভাবে হবে, তা ওই সময়ের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেবে।

এ ব্যাপারে সংবিধানে বলা আছে, জাতীয় সংসদের আসন শূন্য ঘোষণা না করেই ৩০০ আসনের নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে।

সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে, ‘সংসদ সদস্যের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবেÑ মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।’ এই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিধান নেইÑ এমন তথ্য জানিয়ে সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।’

এমনকি ৫৬ অনুচ্ছেদের ২ উপ-অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close