মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পদ্মা সেতুতে বিশ্বের প্রথম খাঁজকাটা পাইল

পদ্মা সেতুর কঠিন চ্যালেঞ্জ সাফল্যে পরিণত হচ্ছে খাঁজকাটা (ট্যাম) পাইল বসিয়ে। দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বিশেষ এই পদ্ধতিতে পাইল স্থাপন বিশ্বে এই প্রথম। পদ্মা সেতুর ১১টি খুঁটিতে বিশেষ এই পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে। সেতুর এই ১১ খুঁটির (পিয়ার) ৭৭টি টিউব ওয়ার্কশপে নেওয়া হয়েছে। সেখানে খাঁজকাটার কাজ চলছে। ৩ মিটার ডায়ার প্রতিটি পাইল টিউবে ১০টি করে খাঁজ লাগানো হচ্ছে। এই খাঁজ দিয়েই সিমেন্ট মিশ্রণ চলে যাবে নদীর তলদেশের নরম মাটিতে। এই বিশেষ সিমেন্ট মিশ্রণ মাটিকে শক্ত ভিতে নিয়ে আসতে সক্ষম। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞরা এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করছেন।

বিশাল স্টিলের এই টিউবগুলোতে মজবুতভাবে খাঁজ স্থাপন করা হচ্ছে। এই খাঁজ স্থাপনের কারণে ৩ মিটার ডায়ার প্রতিটি পাইল টিউবের ডায়া বেড়ে ৩ মিটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৩ মিলিমিটার। কারণ প্রতিটি খাঁজ ১.৫ মিলিমিটার। তাই দুই পাশ মিলে এর দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩ মিলিমিটার ডায়ার বৃদ্ধি হয়েছে। ট্যামগুলোর মুখের অংশ এমনভাবে চোখা রাখা হয়েছে যাতে মাটিতে প্রবেশ সহজ হয়। তবে খাঁজসহ এই পাইল স্থাপনে হ্যামারের শক্তি বেশি ব্যবহার করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, ৩টি উচ্চক্ষমতার জার্মানি হ্যামার পাইল ড্রাইভ করছে। ১৯০০ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি বটম সেকশন করে থাকে। তবে এই খাঁজকাটা পাইলটি ১৯০০ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি ড্রাইভ করতে পারবে না। এটি ড্রাইভ করবে সাড়ে ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যামার।

প্রকৌশলীরা জানান, পাইল স্থাপনের পর এই খাঁজ দিয়ে হাইপ্রেসার সিমেন্টের মিশ্রণ পাইলের আশপাশের মাটিতে প্রবেশ করবে। তাই পাইলের পাশে অতিরিক্ত হিসাবে এই খাঁজের এক মিটার পর পর ছোট্ট আকারে অর্থাৎ ৮ মিলিমিটার আকারের ছিদ্র রয়েছে। খাঁজটির সোজাসুজি এবং পাশাপাশি ৩টি করে ছিদ্র রয়েছে। প্রতিটি পাইল টিউবের ১০টি এমন খাঁজ দিয়ে এই সিমেন্ট মিশ্রণ প্রবেশ করবে। খাঁজের মধ্যে সেভাবেই ভেতরে ফাঁকা রেখে চ্যানেল করা হয়েছে। এগুলোর মূল টিউবের অতিরিক্ত। তাই আগের তৈরি করা টিউবগুলোর ফের ওয়ার্কশপে নিয়ে এই খাঁজ স্থাপন করা হচ্ছে। আর এই পদ্ধতিতে সিমেন্ট প্রবেশ করানো হবে নরম স্তরের মাটিতে। প্রায় ১১০ মিটার দীর্ঘ এই পাইলের ৬০ থেকে ৬৫ মিটারে এই সিমেন্ট মিশ্রণ প্রবেশ করবে। তবে বাকি অংশে খাঁজ থাকলেও সেই স্থানে ছিদ্র রাখা হয়নি। তবে ওপর থেকে যেহেতু সিমেন্ট নিচে প্রেরণ করতে হবে তাই পাইলটির একেবারে প্রথম থেকেই অতিপোক্ত আকারের এই খাঁজ স্থাপন করা হয়েছে। আর এই খাঁজগুলো সরাসরি আনা হয়েছে চীনের বিশেষ ওয়ার্কশপে তৈরি করে। কারণ পদ্মা সেতুর ওয়ার্কশপে এমন শক্ত খাঁজ তৈরির মেশিন নেই। সমুদ্রপথে আসা এসব খাঁজ এখন স্থাপন করে চলেছে কুমারভোগের বিশেষায়িত ওয়ার্কশপে।

বিশাল আকারের স্টিলের এসব পাইল নাড়াচাড়াসহ বেশিরভাগ কাজই হচ্ছে মেশিনে। সেখানে দেশি-বিদেশিরা মিলে এসব সূক্ষ্ম কাজগুলো করছে।

সেতুর ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ২৬ এবং ২৭ এই সাতটি খুঁঁটিতে এই খাঁজকাটা পাইল স্থাপন করা হবে। আর এই সাতটি খুঁটিরই নকশা অনুমোদন বাকি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই অনুমোদিত চূড়ান্ত নকশা হাতে আসবে। তবে এর আগেই নকশার খসড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী টিউব তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে।

এদিকে নকশা অনুমোদন করার আগে এই পাইলগুলোর কাছাকাছি একটি করে হুবুহু টেস্ট পাইল স্থাপন করা হয়েছে। ২৬ ও ২৭ নম্বর খুঁটির মাঝামাঝি এই টেস্ট পাইল স্থাপন করা হয়েছে। এরই কাছাকাছি কনস্ট্রাকশন পাইল স্থাপন করা হয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হওয়ার পর পরই এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, ৬, ৭, ৮ ও ১১ নম্বর খুঁঁটির দীর্ঘ হচ্ছে ১০৪ মিটার। এর সঙ্গে ওপরের অংশে থাকছে আরো ছয় মিটার। আর ২৬ ও ২৭ নম্বর খুঁঁটির দীর্ঘ ১০৬ মিটার। এর সঙ্গেও ওপরের অংশে আরো ছয় মিটার যুক্ত থাকছে।

পদ্মা সেতুর পাইলগুলো রয়েছে বিভিন্ন গভীরতায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গভীরতা রয়েছে অর্থাৎ ১২২ মিটার দীর্ঘ পাইল বসাতে হয়েছে জাজিরা প্রান্তের ৩৭, ৩৮, ৩৯ এবং ৪০ নাম্বার খুঁটিতে। এছাড়া অন্যান্য খুঁটির গভীরতা রয়েছে ১১৪ মিটার, ১১২ মিটার, ১১১ মিটার, ১০৪ মিটার, ১০৬ মিটার ও ৯৮ মিটার করে। এর প্রতিটির সঙ্গেই ওপরে আরো ৬ মিটার যুক্ত থাকছে। তবে দুই প্রান্তের অর্থাৎ দুই তীরের খুঁটি দুটির গভীরতা ৮০ মিটার করে।

ষষ্ঠ স্প্যান বসছে ১৩ ও ১৪ নম্বর খুঁটিতে : পদ্মা সেতুর ষষ্ঠ স্প্যান বসছে ১৩ ও ১৪ নম্বর খুঁটিতে। তিন নম্বর মডিউলের প্রথম স্প্যান অর্থাৎ ‘৩এ’ নম্বর স্প্যানটি এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর বিশেষায়িত ওয়ার্কশপে এসে পৌঁছেছে। এটি জোড়া লাগানোর কাজ পুরোদমে চলছে। সেতু মাওয়া প্রান্তে মূল পদ্মায় স্প্যানটি বসবে।

মাওয়ায় খুঁটি থাকলেও স্প্যান বসছে না যে কারণে : পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে চার খুঁটি পুরোপুরি সম্পন্ন হয়ে আছে। এই চার খুঁটিতে ৩টি স্প্যান স্থাপন করার কথা। কিন্তু মডিউলের এক পাশ থেকে করতে হয় বলে এটি স্থাপন করা যাচ্ছে না। এই অংশটি সেতুর ১ নম্বর মডিউলভুক্ত। এই মডিউলের প্রথম প্রান্তে ১ নম্বর খুঁটি। অর্থাৎ তীরের খুঁটি। ১৬ পাইলবিশিষ্ট এই খুঁটির পাইল হলেও এখন নিচের ক্যাপ তৈরির কাজ চলছে। খুঁটি ওপরে উঠতে আরো সময় লাগবে। এছাড়া এই মডিউলের শেষ খুঁটি ৭ নম্বর খুঁটি। ৭ ও ৬ নম্বর খুঁঁটিতে হবে খাঁজকাটা পাইল। এর নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়ায়। সেতুর মূল কাজের উদ্বোধনীতেই এই ৭ নম্বর খুঁটির পাইলের কাজ শুরু হয়। সঙ্গে ৬ নম্বর খুঁটিরও পাইল স্থাপনের কাজ শুরু হয়। দুইটি খুঁঁটিতেই প্রথম দফায় ৩টি করে পাইল স্থাপন করা আছে। এই দুই খুঁঁটির ওপরই প্রথম স্প্যান বসার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী ‘১এফ’ স্প্যান প্রথম আসে চীন থেকে। এটি ফিটিংয়ের পর রং করে রাখা হয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। তবে মাটির তলদেশে নরম মাটি পাওয়ার কারণে এই পাইল স্থাপন আর করা হয়নি। তাই খুঁটি না হওয়ায় এই স্প্যান এখন স্থাপন করা হয়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close