ফয়জুন্নেসা মণি

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

প্রকৃতি-প্রতিবেশ

শাপলা ও শালুকের গল্প

‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে/

যে দেশেতে কলমি কমল কনক হয়ে হাসে/

সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ।’

আমার প্রিয় জন্মভূমির রূপটাই এমন অপরূপ। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। জলের ওপর ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য সত্যিই যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে। সারা দেশে হাওর-বাঁওড় জলাভূমিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান কয়েকটি জলজ উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম প্রিয় নাম শাপলা ও শালুক। এক সময় গ্রামবাংলার বিলে-ঝিলে ও ডোবা-নালায় এই ফুলের সমারোহ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাই জাতির জনক জাতীয় ফুল হিসেবে শাপলাকে বেছে নিয়েছিলেন। শাপলা এক ধরনের জলজ উদ্ভিদ। পাতা বড়, গোলাকার, ভাসমান এবং ফুল দৃষ্টিনন্দন। শাপলা প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫০। জন্মে নানা দেশে। বাংলাদেশে দুটি সাদা রঙের ও লাল রঙের রক্তকমল শাপলা হয়। শাপলা গাছ ও ডাঁটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। নরম কচি আর খসখসে এই ডাঁটা খালি মুখে কিংবা ঝাল লবণ ও তেঁতুল মাখিয়ে মুখরোচক সবজি হিসেবে গ্রামের মানুষ তাদের রসনাবিলাস করত। তাছাড়া শাপলা ডাঁটা মাছ-মাংস রান্নার উৎকৃষ্ট তরকারি হিসেবে এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। দুই তিন মাস বয়স হলেই শাপলা ফুলের পাপড়ি ঝরে যায়। মাথায় এক প্রকার ফুলের মতো গুছি তৈরি হয়, যা গ্রামবাংলায় ঢ্যাপ নামে পরিচিত। গ্রামবাংলার বিলে-ঝিলে ও ডোবা-নালায় এই ফুলের সমারোহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ঐতিহ্যবাহী শাপলা, শালুক আর ঢ্যাপ এখন তেমন আর চোখে পড়ে না।

শাপলা সাধারণত লাল এবং সাদা রঙের হয়। এটি অনেকের কাছে খুবই ভালো সবজি হিসেবেও সমাদৃত। পানির ওপর ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে শাপলা ফুলের সেই সমারোহ আজ আর নেই। দুই-তিন মাস বয়স হলেই শাপলা ফুলের পাপড়ি ঝরে যায়। মাথায় এক প্রকার ফুলের মতো গুছি তৈরি হয়, যা গ্রামবাংলায় ঢ্যাপ নামে পরিচিত। এই ঢ্যাপের মধ্যে অসংখ্য বীজদানা থাকে। এসব বীজদানা রোদে শুকিয়ে চাল তেরি করা হয়। ঢ্যাপের পুষ্টিকর চাল থেকে তৈরি করা খৈ আর নাড়–র মজাই আলাদা। কাঁচা ঢ্যাপের দানা কেউ কেউ খালি মুখেও খেতে পছন্দ করেন। এক সময় বর্ষা মৌসুমে দেশের নদী-নালা খাল-বিল, রাস্তার দু’পাশে জলাশয়ে ব্যাপকভাবে শাপলা ফুলের মনোরম দৃশ্য দেখা যেত। বর্ষা থেকে শরতের শেষ পর্যন্ত নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয়ের নিচু জমিতে এমনিতেই জন্মাত প্রচুর শাপলা-শালুক ও ঢ্যাপ। অনেকেই এসব পানিফল তাদের খাদ্যের তালিকায় রাখত। শিশুরা তো বটেই, সব বয়সের মানুষ রঙ-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে মুগ্ধ হতো। শাপলা গাছ ও ডাঁটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। নরম কচি আর খসখসে এই ডাঁটা খালি মুখে কিংবা ঝাল লবণ ও তেঁতুল মাখিয়ে মুখরোচক সবজি হিসেবে গ্রামের মানুষ তাদের রসনাবিলাস করত। তাছাড়া শাপলা ডাঁটা মাছ-মাংস রান্নার উৎকৃষ্ট তরকারি হিসেবে এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। শাপলা গাছের গোড়ায় একাধিক গুটির জন্ম হয়। গুটিগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এগুলোই শালুক নামে পরিচিত। বাংলাদেশের অতি পরিচিত এই ফুল শাপলা-শালুক আজ বিলুপ্তির পথে। ঐতিহ্যবাহী শাপলা, পানিফল, শালুক আর ঢ্যাপ আজ তেমন চোখে পড়ে না। জমিতে অতি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শাপলাফুল। গ্রামবাংলার অনেকেই চুলকানি এবং রক্ত আমাশয় নিরাময়ের জন্য ঔষধি গুণসম্পন্ন এই শাপলা খুঁজে ফেরেন। শালুক পাওয়া যায় এই গাছের মাটির নিচের মূল অংশে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিই নয়, এসব পানিফল ও ফুলের রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। ভেট ও শালুকেরও রয়েছে মুখরোচক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। গ্রামের মানুষের কাছে শালুক অত্যন্ত সুস্বাদু ও লোভনীয় খাদ্য। প্রবীণরা জানান, অভাবের সময় বিল থেকে এসব শালুক সংগ্রহ করে মানুষ ভাতের বিকল্প হিসেবে সিদ্ধ করে খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করত। মৌসুম অনুযায়ী শাপলা, শালুক ও সিংড়া কালে-ভদ্রে গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারগুলোতে চোখে পড়লেও দাম অনেক বেশি। একেক শালুকের ওজন সাধারণত ৪০ থেকে ৭০ গ্রাম হয়ে থাকে। শালুক অত্যন্ত সুস্বাদু ও লোভনীয় খাদ্য। শালুক আগুনে পুড়িয়ে কিংবা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। সে সময়ে শরতের শেষে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাপলা-শালুক ও ঢ্যাপ তোলার ধুম পড়ে যেত।

শালুক-শাপলার ভেষজ গুণ অনেক। শালুকে হজম শক্তি বাড়ে, দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করে এবং শরীরে পর্যাপ্ত শক্তিও জোগায়। শাপলা-শালুক স্নিগ্ধকারক, শীতলকারক, পিত্ত প্রশান্তিদায়ক, হৃদযন্ত্রের শক্তিদায়ক, পিপাসা নিবারক, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া নিবারক, আমাশয় ও পেট ফাঁপায় উপকারী। শাপলা-শালুক দিয়ে যেসব রোগের চিকিৎসা সম্ভব তার মধ্যে রয়েছে পিত্তজ্বালায় (পিত্তাধিক্যে) কাঁচা শাপলা বেটে রস করে আধাকাপ করে সকাল-সন্ধ্যা পান করলে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই উপকার পাওয়া যাবে। যাদের প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে, তারা কাঁচা শাপলার আধাকাপ রস দিনে ৩-৪ বার অথবা শুকনো ৫ গ্রাম শাপলা ২ কাপ পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সকাল-বিকাল পান করলে উপকার পাবেন। গলব্লাডার অপারেশন-পরবর্তী পিত্তের সমস্যায় শাপলা ভেজানো পানি পান বেশ উপকারী। কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার দৃষ্টিনন্দন শাপলা-শালুক আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে শাপলা ফুলসহ পানি ফলগুলো যেন হারিয়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো বটেই, সব বয়সী মানুষই রঙ-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে ব্যাকুল হয়ে যেত। এখন আর গ্রামবাংলার বিলঝিল, ডোবা-নালায় চোখে পড়ে না বাংলাদেশের জাতীয় ফুল ‘শাপলা’। পানিফল, শালুক, ভেট আর সিংড়া। শাপলা ফুলসহ এসব পানিফল যে শুধু পরিবেশ ও প্রকৃতির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করত তা কিন্তু নয়, এসবের রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে গ্রামবাংলার শালুক হতে পারে একটি অর্থকরী ফসল। এর পুষ্টিগুণ আলুর মতো। কাদা মাটিতে বিনা চাষে উৎপন্ন শালুক আহরণ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি এখন অনেকেই তা বাজারজাত করছে। রফতানি হচ্ছে বিদেশেও।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist