পর্যালোচনা
এই রায় একটি মাইলফলক
কামার ফরিদ
নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলায় পাঁচ বাহিনীর সাবেক ১৬ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ ২৬ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া ওইসব বাহিনীর আরো ৯ সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আরো আছেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং তার অপরাধ জগতের ৯ সহযোগী। ক্ষমতার দাপটে প্রভাবশালীরা অপরাধ করে বিভিন্ন সময় পার পেয়ে গেলেও গত সোমবার তা পারেনি। আদালতের রায়ে প্রচলিত ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আদালতের এই রায় বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকল।
রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিপতি নূর হোসেন। চলনে-বলনে ভিআইপি। সামনে-পেছনে সার্বক্ষণিক দেহরক্ষী। সবাই সশস্ত্র। থানা-পুলিশ ছিল অনুগত। ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু। মামলায় দন্ডিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার ইশারায়ই পরিচালিত হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জের অপরাধ জগৎ।
সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার মৃত হাজী বদরউদ্দিনের ৬ ছেলের মধ্যে নূর হোসেন তৃতীয়। ড্রাইভারের হেলপার থাকাকালে ১৯৮৯ সালে শ্রমিক ইউনিয়ন অফিস দখলের মধ্য দিয়ে লাইম লাইটে আসেন ৭ খুন মামলার অন্যতম আসামি নূর হোসেন। যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৯১ সালে দলত্যাগ করে যোগ দেন বিএনপিতে। ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলামকে (নিহত নজরুলের শ্বশুর) পরাজিত করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নজরুল ইসলামকে (নিহত) পরাজিত করে পুনরায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর শুরু হয় নূর হোসেন চেয়ারম্যানের গডফাদার হয়ে ওঠার কাহিনী।
এখানে নূর হোসেনকে কী দোষ দেব? যেখানে শর্ষের মধ্যে ভূত থাকে, সেখানে যে শর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না, তা আমরা সবাই জানি। এখানেও এর ব্যত্যয় হয়নি। নূর হোসেনের মতো একজন ট্রাক ড্রাইভারের সহকারীকে লালন-পালন করে গডফাদার বানানোর প্রক্রিয়ায় যারা ছিলেন, তারা দেশের বাইরের কেউ নন। এ দেশের রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় আজ তিনি গডফাদার, নারায়ণগঞ্জের ত্রাস, ৭ খুনের অন্যতম প্রধান আসামি। রাজনীতিকরা তাদের স্বার্থে নূর হোসেনকে সন্ত্রাস করার জন্য ফ্রি লাইসেন্স দিয়েছেন। দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ তাদের সব নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে এ কাজ করেছে। আজ যদি এই হত্যার দায় কাউকে নিতে হয়, তাহলে প্রথম দায় নিতে হবে এই তিন রাজনৈতিক দলকেই। দুর্ভাগ্য, নূর হোসেনের দায় তাদের কেউই নেয়নি। পুরোটাই নিতে হয়েছে নূর হোসেনকে।
বাংলাদেশের ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে নূও হোসেনের সংখ্যা কম নয়। ছোট-বড় মিলিয়ে সহস্রাধিক তো হবেই। সর্বত্রই চিত্র এক। রাজনৈতিক দল অথবা রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা লালিত হচ্ছে। নূর হোসেনের কপাল খারাপ, তাই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। আদালত তাকে এবং তার সহযোগীদের মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হতে হয়েছে রাজনৈতিক দল অথবা রাজনীতিককে। পরাজিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের ত্রাস নূর হোসেন।
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের মামলায় অপর তিন আসামি র্যাব-১১-র সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লে. কমান্ডার মাসুদ রানার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই তিন কর্মকর্তা র্যাব-১১-তে যোগদানের পর থেকেই শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায় হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাত পরিচয়ের অসংখ্য লাশ, যা ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ৭ জনকে হত্যার মধ্য দিয়ে যবনিকা পড়ে। ২০১৩ সালে র্যাব-১১-এর সিও হিসেবে তারেক সাঈদ, কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে মেজর আরিফ হোসেন এবং সিপিসি-১-এর অধিনায়ক হিসেবে এমএস রানার যোগদানের পর নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে তুলে নেয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। এ সময় সামান্য মুদি দোকানদারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে দুই হাতের আঙুল কর্তন করে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ দিন পর তাজুলের হাত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া যায় (মেঘনা নদীতে)। আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইলকেও একইভাবে অপহরণ করা হয় র্যাব পরিচয়ে। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার যেন কোনো শেষ নেই। তাদের এই অপকর্মের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকরাও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অর্থ ও সম্পদের লোভে তারা ভাড়াটিয়া খুনির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের এই অপকর্মের দায় এখন তাদেরকেই বহন করতে হচ্ছে। কোনো সুহৃদকেই আর দায়ের ভাগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এটাই বোধ হয় প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মেই তারা আজ ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেছেন, র্যাবের কোনো সদস্য কোনো অপরাধে জড়ালে তার সম্পূর্ণ দায় ব্যক্তির; বাহিনীর নয়। লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ যদি শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে জড়ায়, তার দায় কখনো বাহিনী বহন করবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৭ খুন মামলার রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ন্যায়বিচার হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রায়ের মধ্য দিয়ে র্যাব আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
সাত খুন মামলার এই রায়ে আদালত কিছু অভিমত দিয়েছেন। অভিমতে আদালত বলেছেন, এ ঘটনা সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য লজ্জাজনক। একই সঙ্গে জাতির জন্যও বটে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়ে সমগ্র জাতি স্বস্তি পেয়েছে।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, আইন প্রয়োগকারীরা সতর্ক হলো।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, শুধু আইন প্রয়োগকারীরাই সতর্ক হবে? যারা তাদেরকে অনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে লালন করে সমাজ এবং রাষ্ট্রবিরোধী করে তুলেছেন, তাদের কী হবে?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া না গেলে সমাজে র্যাবের এ রকম খুনি ও ডাকাতবাহিনী যে আরো তৈরি হবে, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার রায়ে খুশি হয়েছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। একই সঙ্গে সন্তোষ প্রকাশ করে রায় দ্রুত কার্যকর চেয়েছে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের মেয়ে ডা. সুস্মিতা সরকার এবং চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবার।
সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি বলেছেন, আদালতে যে রায় ঘোষণা হয়েছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট। তিনি মনে করেন, এই রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, দেশে বিচার বিভাগ সুষ্ঠু রয়েছে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন বলেন, উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল রেখে দোষীদের দ্রুত সাজা কার্যকর করা হবে।
তবে দ্রুত কার্যকর করার ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, নিম্ন আদালতে দেওয়া ফাঁসির রায় কার্যকর হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না হাইকোর্ট তা কনফার্ম করেন। বিচারিক আদালতের রায় নথিসহ ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসবে। এখানে আসার পর দ্রুত মামলার শুনানি শুরু করার চেষ্টা করা হবে।
বিষয়টি কমবেশি সবারই জানা। জানা বলেই সাধারণ মানুষের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। তারা ভাবছেন, হাইকোর্ট পর্যন্ত পৌঁছতে কতদিন লাগবে? অলৌকিক কোনো কারণে পুরো নথিপত্র আবার হিমঘরে চলে না যায়।
একই সঙ্গে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, অজ্ঞাত কারণে দন্ডপ্রাপ্ত এসব আসামির সাজা নতুন আঙ্গিকে না বেরিয়ে আসে।
তারা এও বলেছেন, তাদের শেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালত সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থেকেই রায় ঘোষণা করবেনÑ এই আস্থা তাদের আছে। এ দেশের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, আদালতের সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
"