ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

আরাকান আর্মির সাফল্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কতটা সহায়ক

২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রেজিস্টেন্ট গ্রুপগুলো যে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছে, তা ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির নিয়মিতভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্টেশন আক্রমণ করে একের পর একের শহরতলি দখল করে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি। যে তিনটি সংগঠন মিলে ‘ত্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স’ গঠন করে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আরাকান আর্মি, যারা রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘদিন থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, আরাকান আর্মি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, বীরত্বের সঙ্গে এবং তীব্র মনোবলের সঙ্গে মিয়ানমারের মহাশক্তিধর সেনাবাহিনীকে একের পর এক আক্রমণের মধ্য দিয়ে পরাজিত করছে। আরাকান আর্মির তীব্র এবং সাঁড়াশি আক্রমণে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, সীমান্তচৌকি এবং সামরিক ঘাঁটি থেকে পালিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা, সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত সীমান্ত পুলিশ এবং অন্যান্য বর্ডার কর্মকর্তারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পালিয়ে যাওয়া সীমান্ত পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর সৈন্যরা আশ্রয় নিয়েছে ভারতে, থাইল্যান্ডে এবং বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩৩০ জন মিয়ানমারের নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে। তবে এরপর আরো ১৭৯ জন সীমান্ত রক্ষায় নিহত পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কিছু সৈনিক পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী আরো ২০ শতাধিক সীমান্তে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশে প্রবেশ করার জন্য। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ইতিমধ্যে বেশ কিছু সৈন্য ভারত এবং থাইল্যান্ডেও প্রবেশ করেছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে পরাজিত হচ্ছে, আত্মসমর্পণ করছে এবং টিকে থাকতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ৭টি এবং চীন রাজ্যের একটিসহ ৮টি টাউনশিপ নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের প্রবাসী সাংবাদিকদের পরিচালিত সংবাদপত্র ইরাবতির ভাষ্য অনুযায়ী, আরাকান আর্মি এখন রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটেওতে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং যেকোনো সময় এই আক্রমণ তারা করতে পারে। বিভিন্ন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অব্যবহৃত বোমা ব্যবহার করেই তারা রাখাইনের রাজধানী আক্রমণ করে দখল করতে পারে।

অন্যদিকে আরাকান আর্মি যে রাখাইনের রাজধানী দখল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে খবর প্রচারিত হওয়ার পর রাজধানী সিটেও থেকে মানুষ দলে দলে অন্য শহরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। এতে করে সহজেই অনুমান করা যায়, রাখাইন রাজ্যে দায়িত্বরত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মনোবল প্রায় ভেঙে পড়েছে এবং আরাকান আর্মিকে মোকাবিলা করার শক্তি ও সামর্থ্যের মধ্যে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। মিয়ানমারের শক্তিধর সেনাবাহিনী সিটেওর মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা মানুষ সেনাবাহিনীর ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না বলেই রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে অন্য শহরতলিতে বা নিকটবর্তী

গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। এ অবস্থা অন্য রাজ্যগুলোতেও কমবেশি একই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি নিকট ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি রাখাইনের রাজধানী সিটেও দখল করে নেয় এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইন থেকে বিতাড়িত করে পুরো রাখাইন রাজ্যকে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রাখাইন রাজ্যকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মুক্ত করে তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?

অনেকে মনে করছেন, আরাকান আর্মি রাখাইন দখল করলে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পালে নতুন করে হাওয়া লাগবে। কিন্তু আরাকান আর্মি পুরো রাখাইন রাজ্যটাকে দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করলেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, সেটা আমার মনে হয় না। তা ছাড়া মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল করলেও তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে কোনো ধরনের সংলাপ শুরু করা বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের কূটনীতিক সম্পর্কের যে বিদ্যমান কাঠামোতে, সেখানে সেটা একেবারেই সম্ভব নয়। আবার আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল করলেও তারা যে রোহিঙ্গাদের খুবই উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানিয়ে রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। ইতিমধ্যে আরাকান আর্মির প্রধান মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সংবেদনশীল, রোহিঙ্গাদের থেকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তারা আশাবাদী, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের প্রতি যা হয়েছে সেটার জন্য তারা সহানুভূতিশীল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় না আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের প্রতি এতটা সংবেদনশীল, এতটা আন্তরিক এবং এতটা সহযোগিতার মনোভাবসম্পন্ন। তাই আরাকান আর্মির প্রধান রোহিঙ্গা সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা কিছু সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, সেটা যতটা না রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তরিকতার জন্য এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তার চেয়ে অধিকতর হচ্ছে রোহিঙ্গাদের কথা বলে রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংবেদনশীলতাকে ব্যবহার করে নিজেদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা। তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আরাকান আর্মি একাই একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও দখল করে রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো বহু পুরোনো, বহু জটিল এবং বহুল আলোচিত একটি বিষয় দ্রুত সমাধান করে ফেলবে এবং ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, এ ধরনের চিন্তা অবান্তর এবং অবাস্তব। তাই আমি মনে করি, আরাকান আর্মি রাখাইনে মিয়ানমারের জান্তাবাহিনীকে পরাজিত করছে, এর সপক্ষে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এবং নিপীড়নবিরোধী সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে আমাদের খানিকটা পুলকিত করে, আপ্লুত করে আশাবাদী করে কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আরাকান আর্মি কর্তৃক রাখাইনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট নয়। বরং মিয়ানমারের সামরিক সেনা শাসকের কর্তৃত্ব এবং স্থায়িত্ব নির্মূল করে যদি কোনো গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সে সরকারের অধীনে একটি রাষ্ট্রীয় পলিসির অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা সমাধান করতে হবে। তখন রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি কী? রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তাদের মনোভঙ্গি কী? এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তাদের চিন্তাভাবনা কী? তার ওপর নির্ভর করবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা।

তাই জান্তাবিরোধী আন্দোলনের এ রকম একটি জটিল এবং ক্রান্তিকালে আরাকান আর্মির প্রধানের বক্তব্যকেই ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ নেওয়া যাবে না, কেননা এ মুহূর্তে তাদের বক্তব্য অনেক বেশি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং ট্র্যাটেজিক। সেটা যতটা না বাস্তবতার আলোকে কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আলোকে, তার চেয়ে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের জন্য। তাই আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল করলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে রাখাইন থেকে বিতাড়িত করলেও অতি দ্রুতই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে- এটা আশা করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close