মো. সাখাওয়াত হোসেন

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

মতামত

উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়ুক কর্মসংস্থান

উন্নয়ন প্রত্যয়টির বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যয়টির বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, সেটি ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ একটি স্থায়িত্বশীল ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পাবে। মেগা প্রজেক্টসহ উল্লেখযোগ্য প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় উন্নয়ন বাংলাদেশে দৃশ্যমান এবং উন্নয়নকে প্রকৃত অর্থে কাজে লাগানোর জন্য কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে কর্মসংস্থানের পরিধি বৃদ্ধি করে দেশের সামষ্টিক উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়। বিশেষ করে সক্ষম জনগোষ্ঠী কেউই যাতে কর্মহীন না থাকে, সেই ধরনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনশক্তিকে যথাযথভাবে এবং সর্বোচ্চ উপায়ে ব্যবহার নিশ্চিত করে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কলা, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়েও দক্ষ জনশক্তির উপস্থিতি স্বজাত্যবোধের বিকাশে সহযোগিতা করে থাকে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যমান সুবিধাগুলোকে সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়ে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান নিশ্চিতে যৌথভাবে কাজ করে যেতে হবে।

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গত বছরের শেষ তিন মাসে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে ৪০ হাজার। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। এক বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা ৪০ হাজার বেড়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা ডলারসংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও নতুন বিনিয়োগ না হওয়াকে বেকারত্ব বাড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুই বছর ধরে দেশ করোনা-সংকটের মধ্যে ছিল, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগও কমেছে। ডলারসংকটের কারণে অর্থনীতির যে মূল চালিকা শক্তি গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহেও মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বেকারত্ব বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবু অচলাবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ দেখিয়ে চলছে।

বিবিএস বলছে, সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেননি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাদেরই বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি জরিপের আগে ৩০ দিন বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন, তারাও বেকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। যেখানে রাত-দিন পরিশ্রম করেও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ সংসার চালাতে পারছেন না, সেখানে সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ পাওয়া তাদের জন্য কোনো অর্থ বহন করে না। এটা কোনোভাবে বেকারত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে না। দেশে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান নেই বলেই বেকার তরুণরা জীবনবাজি রেখে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাদের ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিটা দেশের বাইরে প্রবাসে যান। তাই দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে আছে। বিবিএসের হিসাবে বেকারের বাইরে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে সেই সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ। যাদের বড় অংশই শিক্ষার্থী, অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক লোক। শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। গত ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৫৫ লাখের বেশি। আর শ্রমশক্তির বাইরে থাকা পুরুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৮ লাখের বেশি।

প্রান্তিকভিত্তিক হিসাবের বাইরে বছরওয়ারি বেকারের একটি গড় হিসাব দিয়েছে বিবিএস। বছরওয়ারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সাময়িক হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা বেশ কমেছে। গত বছর শেষে বেকার লোকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৭০ হাজারে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮০ হাজার। বছরওয়ারি হিসাবে, গত বছর শেষে দেশে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশের শ্রমশক্তি আছেন ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৬০ হাজার নারী-পুরুষ। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৮০ লাখ ১০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ডিসেম্বর শেষে দেশে ৭ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার নারী-পুরুষ জরিপের সময়কালের আগের সাত দিনে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৪০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৪৬ লাখ ৭০ হাজার। বিবিএসের হিসাবে, গত ডিসেম্বর শেষে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করেন। শিল্পে এ সংখ্যা ১ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার আর সেবা খাতে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার।

আমাদের যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়ায় এবং ফ্রি ল্যান্সিংয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনলাইনভিত্তিক কাজের দিকে ঝুঁকছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে নারী উদ্যোক্তা তৈরির কাজেও সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এসব উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার কারণে জনশক্তি তৈরি হচ্ছে এবং বেকারত্বের হারও ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সরকার তরুণদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটারভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এবং প্রশিক্ষিত হয়ে তরুণরা বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে যোগদান করছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। যার কারণে বিপুল পরিমাণে টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বলে থাকেন উপযুক্ত ব্যক্তি না পাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার স্বার্থে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশাল অঙ্কের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন আমাদের যে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে, সেটিকে ধরে রাখতে কিংবা উন্নয়নের ধারাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে উদ্ভাবনীমূলক কর্মসংস্থানের ওপর আমাদর জোর দিতে হবে। বিশেষ করে দেখা যায়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের চাহিদার ভিত্তিকে জনশক্তি তৈরি করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য নানামুখী উদ্যোগ ও ব্যবস্থা রাখতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে আসতে হবে, দেশের স্বার্থে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করা যাবে না। রাজনৈতিক স্থিতাবস্থায়ই মূলত বিদেশিদের অতিমাত্রায় বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান করে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে খুব দ্রুত রিটার্ন পাওয়া যায়, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিরল। এসব কারণেই বিদেশিরা ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে বাংলাদেশে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে প্রায়োগিক ও বাস্তবধর্মী শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে টিকে থাকার মানসে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদের যদি দক্ষ ও স্মার্ট হিসেবে দেশের বাইরে পাঠাতে পারি, তাহলে দেখা যাবে রেমিট্যান্সের হারও পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাবে এবং রিজার্ভ সুরক্ষিত থাকবে বাংলাদেশের।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close